১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

পরামর্শকে ৪৭৪ কোটি টাকা ঢেলেও মন্থরগতি

উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প : তীর রক্ষা ব্যয় কিমি. ২৫ কোটি টাকা থেকে ৬৩ কোটি টাকা; বাঁধের ঢাল নির্মাণ ব্যয় কিমি. ৫.২৮ কোটি টাকা থেকে সাড়ে ১১ কোটি টাকা
-

প্রায় অর্ধসহস্র কোটি টাকা পরামর্শকদের পেছনে ঢেলেও প্রকল্পের কাজে রয়ে গেল মন্থরগতি। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়া তো দূরের কথা ৫০ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। এখন পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জড়িত কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইম্প্রুভমেন্ট (উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন) প্রকল্পটি সাত বছরে সমাপ্ত হওয়া দূরের কথা অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সাত বছরে এসে প্রকল্প সংশোধন করে কাজ কমানো হচ্ছে। কিন্তু কাজ কমলেও প্রকল্পের খরচ কমছে না। নদীর তীর রক্ষা ব্যয় কিমি. ২৫ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৩ কোটি টাকায় এবং বাঁধের ঢাল নির্মাণ খরচ কিমি. ৫.২৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ কোটি টাকা হয়েছে সাত বছর পর। বিভাগটি বলছে, প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। সময় বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাতেও প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। তারপরও পিইসি থেকে প্রকল্পটির সংশোধন অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার ও ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে। সিডরের আঘাতে উপকূলবর্তী ৩০টি জেলা বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারমধ্যে পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৩২০০ মানুষ মারা যায়। ঘূর্ণিঝড় সিডরের ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার সহায়তা প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়। সিডরের ক্ষতি নিরূপণে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত যৌথ লোকসান ও চাহিদা নিরূপণ (জেডিএলএনএ) বিষয়ক যৌথ মিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ৬ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত।
ইসিআরআরপির ডিপিপিতে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলের পোল্ডারগুলোকে জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদির কবল থেকে রক্ষাকল্পে কারিগরি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং উপকুলীয় বাঁধ উন্নয়নের জন্য বিস্তারিত ডিজাইন শীর্ষক সমীক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান ছিল। সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে এই সমীক্ষা সম্পাদন করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সম্পাদিত সমীক্ষা কাজের আলোকে বিশ্বব্যাংক উপকূলীয় অঞ্চলে ১৭টি পোল্ডারকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার উপযোগী করে সার্বিকভাবে বাঁধগুলোকে উন্নয়ন ও পুনর্বাসন করার জন্য ৪০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থসহায়তা প্রদানে সম্মত হয়। সে আলোকে সম্পূর্ণ বিশ্বব্যাংক ও পিপিসিআর অনুদানে ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেইজ-১ শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়। গত ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় হতে অনুমোদনের এক বছর পর প্রকল্পের প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের ৬টি জেলার ১৭টি পোল্ডারকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা উপযোগী করে সার্বিকভাবে বাঁধগুলোকে উন্নয়ন ও পুনর্বাসন করা হবে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চল নদীতে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পাবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় শস্য, প্রাণিসম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পাবে।
প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা : পাউবো ও পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, বাঁধ নির্মাণের এই প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই। কারণ ৬ বছরে অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি অর্থাৎ অর্থ ব্যয় হয়েছে ৪৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ফলে এক বছরে বাকি ৫৫ শতাংশ কাজ কোনোভাবেই সম্ভব না। পাউবো প্রকল্প সমাপ্তির জন্য আরো ২ বছর বাকি সময় চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে। বেশির ভাগ খাতে ব্যয় দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ খাতগুলোতে কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান না হওয়ায় সাতটি পোল্ডারের ক্রয় প্যাকেজ (প্যাকেজ-৩) বাস্তবায়ন বাদ দেয়া হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ১২৪টি পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো নির্মাণের পরিবর্তে ৮৯টি নির্মাণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি অবকাঠামো নির্মাণে খরচ হবে ৩ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। ১৪টি পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো মেরামতের পরিবর্তে এখন ৮টি করা হয়েছে; যাতে ব্যয় হবে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এখানে গড়ে ব্যয় হবে ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
মূল ডিপিপিতে ৬২৪.৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু এখন ৭ বছর পর এসে ৪১২.১৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে; যাতে ব্যয় হবে ৪০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ৯৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা ব্যয় হবে। ৪৮৫.২৯ কিলেমিটার নিষ্কাশন খাল খনন বা পুনখনন করার পরিবর্তে এখন ৩০৫.৮৫ কিলোমিটার কাজ করা হবে। তাতে ব্যয় হবে ৪০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ফলে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ফ্লাশিং ইনলেট নির্মাণ খরচ বাড়ছে সংশোধনীতে। মূল ডিপিপিতে প্রতিটির ব্যয় ছিল ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। এখন ব্যয় বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর ফ্লাশিং ইনলেট মেরামত খরচ প্রতিটিতে বৃদ্ধি পেয়ে ২৬ লাখ টাকা থেকে ২৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা হয়েছে। এখানে প্রতি কিলোমিটার বাঁধের ঢাল প্রতিরক্ষায় খরচ হবে ১১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর প্রতি কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণে খরচ হচ্ছে ৬৩ কোটি ৩ লাখ টাকা।
প্রকল্পের শুরুতে পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয় ৪৫৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত এই খাতে ব্যয় হয়েছে ১৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এখন এই খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ৪৭৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক বলছেন, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে মূসক, আয়করের হার বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি, চুক্তির সংস্থান অনুযায়ী চুক্তি মূল্য সমন্বয়ের ফলে পরামর্শক খাতে ব্যয় বেড়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘসূত্রতা ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। দুই বছর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে উন্নয়ন সহযোগীরা সম্মতি দিয়েছে। মেয়াদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইতোমধ্যে ঋণ চুক্তির মেয়াদ ও ফলাফল কাঠামো হালনাগাদ করা হয়েছে।
প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির সভায় কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দ প্রকল্পের অগ্রগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সময় বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাতেও প্রকল্পটি সমাপ্তি হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন কাজে পরামর্শক সেবা গ্রহণের পরও প্রকল্পে রয়ে গেছে ধীরগতি। এটা সন্তোষজনক নয়। করোনার কারণে প্রকল্পে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ব্যয় কমিয়ে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement