প্রতি এলইডি বাতি ৩৫ হাজার টাকা
উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি: পৌরসভার প্রকল্পে ৩ ধরনের পরামর্শক- হামিদ সরকার
- ০৫ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
উন্নয়ন প্রকল্পে কেনাকাটায় পণ্যের দর দেখলে চোখটা ছানাবড়া হয়ে যায়। যেন দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চলছে এ ব্যাপারে। এ কারণেই হয়তো অনিয়ম ও দুর্নীতি থেমে নেই দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে। প্রকল্পের প্রস্তাবনা থেকেই এই দুর্নীতির শুরু হয়। এরপর পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ছাড় করাতে পারলেই কেল্লাফতেহ। কারণ পিইসির সুপারিশ ছাড়া একনেকে অনুমোদনের জন্য প্রকল্প উপস্থাপনের সুযোগ নেই। প্রস্তাবনাগুলোর জিনিসপত্রের দর দেখা যায় আজগুবি ও অবাস্তব। পৌরসভার রাস্তার জন্য এলইডি একটি লাইটের (বাতি) দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। আর এই দামে কেনা হবে ৮ শ’ বাতি। পটুয়াখালী পৌরসভার জন্য এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ কোটি টাকায়।
প্রস্তাবনা থেকে জানা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পটুয়াখালী পৌরসভার রাস্তাগুলোয় যানজট লেগেই থাকে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অন্য দিকে, দ্রুত নগরায়ণের ফলে নির্বিচারে জলাশয় ভরাট হওয়ায় পানি অপসারণের স্থান ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় ড্রেন না থাকায় বাসাবাড়ির পানি অপসারণ না হওয়ায় সারা বছরই জলাবদ্ধতা থাকে। পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদের জন্য ৩০ কেটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে মাস্টারপ্ল্যান আপডেটের সাথে সাথে কিছু নাগরিকসুবিধাও বৃদ্ধি পাবে। তিন বছরে বাস্তবায়নের জন্য এই প্রকল্পটি অনুমোদনে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কাছে মূল্যায়নে পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে, পৌরসভার সড়কে প্রায় ৪ হাজার পয়েন্টে সাধারণ মানের বাতি রয়েছে। স্থায়িত্ব কম হওয়াতে প্রতি মাসে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংখ্যক বাতি পরিবর্তন করতে হয়। এই এলইডি বাতি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় রাস্তার জন্য ৮ শ’টি এলইডি বাতি স্থাপন হবে। যার জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি সড়কবাতির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। একটি বাতির দাম ৩৫ হাজার টাকা, যা অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য ও আজগুবি। বর্তমানে ৪ হাজার পয়েন্ট রয়েছে। যেখানে এই এলইডি বাতিগুলো স্থাপন করা হবে।
চায়নার বিভিন্ন কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, কোম্পানি ও লাইটের মানভেদে প্রতিটি সেটের দাম ১২ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১৭৮ ডলার পর্যন্ত রয়েছে। যা স্থানীয় টাকায় ৮৫ টাকা হিসেবে ডলারের বিনিময়মূল্য ধরলে সর্বনি¤œ এক হাজার ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ১৩০ টাকা হয়। চায়নার জংসান ইয়াই লাইটিং কোম্পানির দর ৩২.৫ থেকে ৮৪.৫ ডলার প্রতিটি সেটের। হাংজুয়া টেকনোলজির ওয়েব তথ্যানুযায়ী প্রতিটি এলইডি রাস্তার বাতির সেটের দাম ১২ থেকে ৬৫ ডলার পর্যন্ত। প্রতিটি বাতি ওয়াটার প্রুভড। এ ছাড়া ইয়াংজু বেস্টার্ন ইন্টার. ট্রেডিং কোম্পানির সোলার এলইডি ওয়াটার প্রুভড লাইটের সেটের দাম ২০ থেকে ১৫০ ডলার। এগুলো সাড়ে ৭ থেকে ৪২০ ওয়াটের। এ ছাড়া ইয়াংজু ইয়াংফেং নিউ এনার্জি টেকনো. কোম্পানি লিমিটেডের ১৪৮ থেকে ১৭৮ ডলার।
পটুয়াখালী পৌরসভার জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে ১০৭ জনমাস পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি টাকা। এত জন পরামর্শকের পরও ব্যক্তি ১২ জনমাস রাখা হয়েছে। যাদের পেছনে খরচ হবে ১২ লাখ টাকা। এ দিকে, ২০ বছরের জন্য ২০১০-২০৩০ সাল মেয়াদে পটুয়াখালী পৌরসভার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছিল বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রস্তাবনায় প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেই মাস্টারপ্ল্যানের গেজেট স্থানীয় বিভাগ আজ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। ফলে এখন নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান করা হলে সেটার গেজেট প্রকাশ নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে খোদ পরিকল্পনা কমিশনের কাছে।
ডিপিপির ১৪.১ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, পটুয়াখালী পৌরসভার নিজস্ব অর্থে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ১২তলা ভিত্তি সংবলিত ভবনের ডিজাইন করা হয়েছে। আর ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে স্থাপত্য নকশা প্রণয়নের জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ হবে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ এই খরচকে বাদ দিতে বলেছে।
২৫ কোটি টাকার বেশি খরচের কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প হলে তার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা করা উন্নয়ন প্রকল্প বিধিতে বাধ্যতামূলক রয়েছে। কিন্তু এই পৌরসভার নতুন এই প্রকল্পটি ৩০ কোটি টাকার। এখানে একটি প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়েছে, যাতে কারিগরি বিষয়ে বর্ণনা ও আর্থিক এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ উল্লেখ করা হয়নি। বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন এখানে প্রয়োজন বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে।
প্রতি কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নেই যাবে দেড় কোটি টাকা। ২ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ধরা হয়েছে ৩ কোটি টাকা। যেখানে রাজধানী ঢাকার মহাসড়কগুলোর উন্নয়নেও প্রতি কিলোতে এত ব্যয় হয়নি চলমান প্রকল্পে। জলাধার সংরক্ষণসহ সৌন্দর্যবর্ধনে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। সাড়ে ৪ কোটি টাকা ধরা হয়েছে কমিউনিটি রিসোর্স সেন্টার নির্মাণে। আর ১০ কোটি টাকা খরচ হবে পৌর সার্ভিস সেন্টার নির্মাণে। ফটোকপিয়ার মেশিন আড়াই লাখ টাকা।
এ দিকে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, পটুয়াখালী পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ সময়ে বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক অন্য আরেকটি ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প চলমান আছে। পৌর সভাটির জন্য দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান থাকার পরও নতুন করে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা কী?
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান (পরিকল্পনা-১) মুহাম্মদ আমিন শরীফের কাছে এলইডি লাইটের দাম ৩৫ হাজার টাকা ধরার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যা দাম সেটাই ধরা হয়েছে। যদি বেশি ধরা হয়ে থাকে তাহলে পরিকল্পনা কমিশনের পিইসিতে কাটছাঁট হবে। বিষয়টি টেকনিক্যাল, তাই এলডিইডির সাথে কথা বলেন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার প্রকল্পটি ভৌত অবকাঠামো বিভাগে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হবে। বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামীমা নার্গিসের সভাপতিত্বে পিইসি সভা ভার্চুয়ালি হবে। এ ব্যাপারে তাকে ফোন করা হলে তার পরিবারে গুরুতর অসুস্থ রোগী থাকার কারণে তার বক্তব্য জানা যায়নি।
এলইডি লাইট স্থাপনে প্রতিটিতে ব্যয় ৩৫ হাজার টাকার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এত টাকা হওয়ার কথা নয়। পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত দর ধরা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনেক প্রকল্পে সম্প্রতি এসব বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা সব তো আর জানতে পারি না। এত কিছুর পরও এসব ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। ঘটে যাওয়ার পর তদন্ত করা হয়। কিন্তু সেই তদন্তও শেষ হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের ফলাফলও জানা যায় না। অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণেই একের পর এক ঘটনা ঘটছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা