২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজধানীর ২১ লাখ ভবন ত্রুটিপূর্ণ

-

রাজধানীতে ত্রুটিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। এসব ভবন নির্মাণে মানা হয়নি বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)। যদিও অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে ঠিক কতগুলো ভবন নির্মিত হয়েছে তার হালনাগাদ হিসাব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে নেই। তবে তাদের পুরনো তথ্যানুযায়ী রাজধানীতে নির্মিত ভবনের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। এর মধ্যে বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত ভবনের সংখ্যা প্রায় ১৬৫টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমোদনের বাইরে গিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে নকশার সাথে নির্মিত এসব ভবনের মিল নেই। আবার অনেক ভবনের পরিপূর্ণ নকশাও নেই। এসব ভবনে আগুন লাগলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকে। তখন নকশা না দেখেই ফায়ারসার্ভিস কর্মীদের অন্ধকারে উদ্ধারকাজ চালাতে হয়। এ কারণে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে।
এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ এসব ভবনে বসবাস বা ব্যবহারের অকুপেন্সি সনদ, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাসহ নানান অনিয়ম রয়েছে। ফলে কোনো না কোনোভাবে এগুলো বসবাসে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও বছরের পর বছর এগুলোতে মানুষ বসবাস করছে। সংস্থাটির একাধিক জরিপ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর দুই-তৃতীয়াংশ ভবন বা প্রায় ৭৫ শতাংশ ভবনই নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি। ফলে নিরাপদ নগরী বিনির্মাণে কর্তৃপক্ষের (ভবননির্মাতা) উদাসীনতাকেই দায়ী করা হয়েছে। এই জরিপ পরিচালনা করতে গিয়ে নগরীর ২২ লাখ ভবনের মধ্যে মাত্র ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি ভবন সরেজমিন দেখেছে বলে দাবি রাজউকের। কিন্তু এরপরেও সেসব ভবনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রাজউকের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে তাদের আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখের বেশি ইমারত রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ ভবন এক তলার। আর তিন হাজার ২৭৩টি বহুতল ভবন। এই তথ্য ২০১৬ সালের। এ ছাড়া গত অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৩০টি ভবনের প্ল্যান পাস হয়েছে। ফলে বর্তমানে ভবনের সংখ্যা বেড়েছে। তবে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ সালে প্রণীত হয়েছে। এরপর গত ১১ বছরে কমপক্ষে ৬০ হাজার ৫ শ’ থেকে ৮০ হাজারের মতো ভবন হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত রাজউক থেকে ১৬৫টি ভবন ব্যবহারের অনুমতিপত্র বা অকুপেন্সি সনদ সংগ্রহ করেছেন ভবন মালিকরা।
২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ভবনের আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক।
এই আইন অনুযায়ী ভবন নির্মাণের পর বসবাস বা ব্যবহারের জন্য অকুপেন্সি (বসবাস) সনদ বাধ্যতামূলক হলেও ভবন মালিকরা তা নিচ্ছেন না। রাজউকও বিষয়টি নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে মালিকরা ভবনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো ভবন তৈরি ও ব্যবহার করছেন। এতে করে দিন দিন ত্রুটিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজউক বলছে, ভবন নির্মাণের পর রাজউক চাইলেও অকুপেন্সি সনদ দিতে পারে না। তবে সনদ সংগ্রহে ভবন মালিককে বাধ্য করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই সনদ ছাড়া বিদ্যুৎ গ্যাস ও পানি সংযোগ দেয়া হবে না। এই বিষয়টি আইনে না থাকলেও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অপর দিকে অগ্নিপ্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, ভবন নির্মাণে ফায়ারসার্ভিসের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফায়ারসার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজার ২৪টি ভবন নির্মাণে ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে।
নিয়মকানুন না মেনে গড়ে ওঠা রাজধানীর কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা করে প্রায় ৭০ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিল্ডিং কোড যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাজধানীতে বহুতল ভবনের ৯০ শতাংশে ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। এ জন্য ভবন নির্মাণ বিধিমালা প্রয়োগ খুবই জরুরি।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অকুপেন্সি সনদ সংগ্রহ না করায় কোনো ভবন নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাবে না। আর রাজউক মালিকপক্ষকে এই সনদ সংগ্রহে বাধ্য করতে না পারায় ভবন সঠিকভাবে নির্মাণ হচ্ছে কি না তা তদারকি করা যাচ্ছে না। এ কারণে কেউ নকশা না মেনে ভবন নির্মাণ করলে তা ধরা যাচ্ছে না। আর সনদ সংগ্রহ না করায় রাজউকও এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের মতে, ভবনগুলো রি-অ্যাসেস করে প্রতিটি ভবন আলাদা করে দেখতে হবে ভার বহন করার ক্ষমতা ভবনের আছে কি না।
গত বছরের মে মাসে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোর অবস্থা দেখতে পরিদর্শন চালিয়ে প্রায় সবগুলোতেই ত্রুটি পায় রাজউক। রাজউকের ২৪টি দল ১ হাজার ৮১৮টি ভবন পরিদর্শনের পর ১ হাজার ৪৭টি ভবনে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম খুঁজে পায়। এ ছাড়া সে সময় অনুমোদিত নকশা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন ৪৭৮টি ভবনের মালিক।
বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে অসন্তোষ জানিয়েছেন কমিটির দুই সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালী। তারা বলেন, গত অক্টোবরে কমিটি গঠনের পর শেষ ডিসেম্বরে সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে। আমরা যে রেজ্যুলেশন নিয়েছিলাম তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে রাজউক জানায়, ত্রুটি সংশোধনে ভবন মালিকদের তিন মাস সময় দিয়েছিলেন তারা। সেই সময় অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও কাজগুলো হয়েছে কি না, তা আর খতিয়ে দেখা হয়নি। এ জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে তারা। অপর দিকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওই সুপারিশগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা ঠিক করতে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। এখন সেই কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা। তবে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অকুপেন্সি সনদ ছাড়া কোনো ভবনে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সংযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন থেকে এ ক্ষেত্রে আর অনিয়ম হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় অর্থাৎ অকুপেন্সি সনদ সংগ্রহ না করায় কেউ নকশা ব্যত্যয় করে ভবন নির্মাণ করলে তা ধরা যাচ্ছে না। তিনি বলেন এখন ভবনগুলো রি-অ্যাসেস করে প্রতিটি ভবনকে আলাদা করে দেখতে হবে ভার বহন করার ক্ষমতা আছে কি না। এ ছাড়া মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে আইনের প্রয়োগ দরকার। তাতে কেউ আর নিয়ম লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করার সাহস করবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement