২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঋণ আদায় কার্যত বন্ধ : কমে যাচ্ছে ব্যাংকের পুনঃবিনিয়োগ

টেক্সটাইল ও তৈরী পোশাক খাতেই বিনিয়োগ ২ লাখ কোটি টাকা
-

ব্যাংক খাতের বিনিয়োগের প্রায় দুই লাখ কোটি টাকাই রয়েছে দু’টি খাতে। আর এ দুই খাতের মধ্যে তৈরী পোশাক খাতে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং টেক্সটাইল খাতে রয়েছে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত মার্চ থেকে ব্যাংকের ঋণ আদায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি থেকে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ওপর শিথিলতা আরোপ করেছে। বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধ না করলেও কাউকে ঋণখেলাপি করা যাবে না। এ কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যবসায়ীদের চাপও দেয়া যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকের নগদ আদায় আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কিন্তু বিপরীতে আমানতকারীদের চাহিদা অনুযায়ী মুনাফাসহ ফেরত দেয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতা পরিশোধ, ভবনভাড়াসহ নানা ইউটিলিটি বিল পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর পুনঃবিনিয়োগ করার সক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তাদের জানা মতে করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে তৈরী পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশী ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বাতিল করা হয়েছে। বিভিন্ন উদ্যোক্তার কাছ থেকে তারা এ ধরনের তথ্য পাচ্ছেন। কিন্তু সবশ্রেণীর উদ্যোক্তাই মূলত মার্চ থেকে ঋণ পরিশোধে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আবার ব্যাংকগুলোও উদ্যোক্তাদের কোনো চাপ প্রয়োগ বা ঋণ আদায়ের বিষয়ে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রথমে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত, পরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের জন্য শিথিল করা হয়েছে। সাধারণত কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর তাকে ঋণখেলাপি করা হতো। আর ঋণখেলাপি হলে তিনি নতুন করে ঋণসুবিধা পান না। এ কারণে ঋণখেলাপি যাতে না হন সে জন্য তারা ব্যাংকের কাছে আসতেন। ঋণ পরিশোধ করতেন। ব্যাংকও গ্রাহকের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে যতটুকু সম্ভব ছাড় দিয়ে ঋণ আদায় করত। গ্রাহকরা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করলে ওই অর্থে ব্যাংক অন্য গ্রাহকের মধ্যে পুনঃবিনিয়োগ করে। পাশাপাশি একটি অংশ দিয়ে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করত। কিন্তু বাস্তবতা হলো গত মার্চের পর থেকে কোনো ঋণই তেমন আদায় হচ্ছে না। আবার করোনার প্রভাবে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে আমানতও পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু কষ্টের দায়ে অনেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। ফলে ব্যাংকের অর্থের ইনফ্লো কমে গেছে। কিন্তু বেড়েছে আউটফ্লো। এটাই ব্যাংকের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, যেটুকু আদায় ও আমানত পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে বিদ্যমান লেনদেন করা হচ্ছে। কিন্তু পুনঃবিনিয়োগ বেশির ভাগ ব্যাংকই করতে পারছে না।
তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থার উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে সেপ্টেম্বরের পরে বোঝা যাবে অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, খাতভিত্তিক ঋণের মধ্যে তৈরী পোশাক খাত ও টেক্সটাইল খাতেই ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। এ দুই লাখ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ঋণ রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যা দুই খাতের মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। এ হিসাব গত ডিসেম্বরের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেহেতু জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না, সে কারণে বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ঋণ পরিশোধ করছেন না। ফলে ডিসেম্বরের পর থেকে ঋণখেলাপির হিসাবও হালনাগাদ করা হচ্ছে না। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কী পরিমাণ তারও সঠিক হিসাব এই মুহূর্তে বলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের পর প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। এর আগ পর্যন্ত অন্ধকারেই থাকতে হবে, যা হওয়া উচিত নয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগও দেয়া যাচ্ছে না। এতে সরকারঘোষিত প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনার প্যাকেজ বাস্তবায়নে তাই অনেকটা চলছে কচ্ছপ গতিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ব্যাংকই প্রণোদনার প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদারকি করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে বলাও হচ্ছে। দ্রুত বিনিয়োগের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা মনে করেন, প্রণোদনার প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে পারলে অর্থনীতির চাকা অনেকটাই সচল হতো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসক্ষমতা কমে যাওয়ায় এটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসক্ষমতা বাড়ানোর প্রতিই আগে জোর দিতে হবে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement