২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৭০ বছর পর খুলনার আদি পাট মিলগুলোর করুণ অবসান

গৌরব মুছে যাবে; কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হবে
-

আবহমানকাল থেকে পৃথিবীতে তন্তুবিশিষ্ট উদ্ভিদ পাটের অস্তিত্ব দেখা যায়। এ পাটের শতকরা ৯০ ভাগ শুধু সাবেক পূর্ববাংলা, এখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে উৎপন্ন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এলাকায় পাট শিল্পের শুরু হয়েছিল তৎকালীন ১৯৫০ সালে তৎকালীন ইপিআইডিসির তত্ত্বাবধানে। গড়ে উঠেছিল ৭৭টি জুট মিল। পাট দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাটশিল্প ব্যবস্থাপনার ভার দেয়া হয় বিজেএমসিকে। এ সংস্থার তত্ত্বাবধানে ২০২০ সালের জুন মাসের শেষ দিনে সে গৌরবময় পাটশিল্পের আদি মিলগুলো নীরবে অন্তিম দশায় পড়ল।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশরা দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে উপমহাদেশ ত্যাগ করে। সে সময় ইংরেজ মুলুকের ইউরোপে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহর আর এখানে কলকাতা এবং আশপাশে ছিল পাটশিল্প বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবটুকু। সেখানে জুট মিল ছিল ১০৮টি। পূর্ববাংলার দায়িত্ব ছিল উৎপন্ন পাটের একচেটিয়া কারবারি মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া। দেশ বিভাগের পর পর তাই পাট নিয়ে বেচাইন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভারত সরকারকে লিখিতভাবে কলকাতার জুট ইনস্টলেশনসমূহ এবং হলদিয়া বন্দর রয়্যালটি পরিশোধ সাপেক্ষে ছয় বছর ব্যবহার করতে দেয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু ভারতীয় সরকার সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় যত দ্রুত সম্ভব এখানে পাটশিল্প বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (ইপিআইডিসি) গঠন করে আগ্রহীদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। প্রথম সাড়া দেয় কলকাতার ব্যবসায়ী আদমজী গ্রুপ। তখন এ গ্রুপের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন আবদুল ওয়াহিদ আদমজী। ইপিআইডিসি ও আদমজী গ্রুপের ফিফটি-ফিফটি শেয়ারে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিল স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। উদ্যোক্তা জরুরি ভিত্তিতে স্থাপনা গড়ে তোলেন। ইপিআইডিসি মেশিনারি আমদানির ব্যবস্থা করে। ১৯৫৫ সালে আদমজী মিল ৩০০০ তাঁত (লুম) এবং ৩১ হাজার ২০০ টাকু (স্পিন্ডেল) নিয়ে উৎসব ও উদ্দীপনার সাথে উৎপাদন শুরু করে। কালক্রমে এ মিল সম্প্রসারিত হয়ে সে সময়কার দুনিয়ার পাটশিল্পের দুই কেন্দ্র স্কটল্যান্ডের ডান্ডি ও কলকাতাকে টেক্কা দিয়ে বিশ্বের বৃহৎ জুট মিলের স্বীকৃতি অর্জন করে।
একই সময়ে সারা দেশে জুট মিল স্থাপন করা হতে থাকে। আদমজী মডেলে এবং উদ্যোক্তাদের নিজস্ব অর্থায়নে মিল গড়ে ওঠে। করিম জুট মিলস, লতিফ বাওয়ানী, আমিন, রাজশাহী, কর্ণফুলী জুট মিল ইত্যাদি তাদের কয়েকটি। তবে জুট মিল স্থাপনে বলা যায় বেশি উপকৃত হয় খুলনা। এখানে গড়ে ওঠে আদমজীর পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিসেন্ট জুট মিল। ১৯৫২ সালে আগা খান সম্প্রদায়ের নেতা প্রিন্স করিম আগা খান খুলনার খালিশপুরে ১১৩ একর জমির ওপর এ মিল স্থাপন করেন। পরে তিনি ক্রিসেন্টের পাশেই পিপলস (খালিশপুর) জুট মিল স্থাপন করেন। এ দুই মিলে কাজ করতেন এমন প্রবীণ লোকদের মিলের সুখের দিনের স্মৃতিচারণ শুনেছি। প্রিন্স করিম পিপলস মিল করার পর বিয়ে করেন এবং সব মিলের শ্রমিকদের প্রত্যেককে ৫ টাকা করে উপহার দেন। খালিশপুরে আরো স্থাপিত হয় প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল ও মাড়োয়ারি (দৌলতপুর) জুট মিল। এগুলোর পাশে ভৈরব নদের অপর পাড়ে একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী স্থাপন করেন স্টার জুট মিল। এর একটু উত্তরে ফুলবাড়ি গেট ও শিরোমণি এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে অ্যাজাক্স, সোনালী ও মহসেন জুট মিল। আরো উত্তরে আটরা এলাকায় স্থাপিত হয় আফিল, ইস্টার্ন ও আলিম জুট মিল। এসব মিল এবং পরবর্তীতে নিউজপ্রিন্ট মিলের কারণে রমরমা হয়ে ওঠে ম্র্রিয়মাণ ও অনুন্নত খুলনা। আবার এখন ক্ষতিগ্রস্তও হলো সবচেয়ে বেশি খুলনা। নোয়াখালী বরিশাল অঞ্চল থেকে এসে অসংখ্য মানুষ এসব মিলে পায় কাজের সন্ধান। নিউজপ্রিন্ট মিল আগেই বন্ধ হয়েছে। সে মিলের মেশিনারি, ২৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম জেনারেটরসহ সব সম্পদ পড়ে থেকে ধ্বংস হচ্ছে। এখন জুট মিলগুলো বন্ধ হওয়ায় রিক্ত নিঃস্ব হয়ে গেল খুলনা। এসব মিলের সহায় সম্পদের হয়তো একই পরিণতি হবে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত দেশে গড়ে উঠে ৮০টি জুট মিল। এর মধ্যে তিনটি ছিল নন-জুট কারখানা। সবগুলো মিল ছিল লাভজনক। যদিও বর্তমানে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পে যেমন প্রণোদনা দেয়া হয়, সেসব মিলেও তা দেয়া হতো। তবে জাতীয় অর্থনীতিতে মিলগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পাট ছিল সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। সে সময় পাট হয়ে যায় সোনালী আঁশ। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের এ সোনালী আঁশ নিয়ে রচনা লিখতে বলা হতো। বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলা হতো, পাট আমাদের সোনালী আঁশ, নারায়ণগঞ্জ প্রাচ্যের ডান্ডি ইত্যাদি। ১৯৭০ সালে পাটশিল্পে সরাসরি কর্মরত ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ এবং এ বছর দেশ পাট রফতানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে ৭৭ মিলিয়ন রুপি। ১৯৫২ সালে পাট থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ২ শতাংশ। ১৯৭০ সালে তা বেড়ে হয় ৪৬ শতাংশ।
১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার দেশের সব শিল্প কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। দেশের জুট মিলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) গঠন করে তার ওপর ন্যস্ত করা হয়। তার পর থেকে শুরু হয় পেছন পানে যাত্রা। সবগুলো মিল লোকসান দিতে শুরু করে। রাজস্ব আয়ে যোগ করা দূরে থাক শুধু বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে গিয়ে দেশবাসীকে মিলগুলোর লোকসান মেটাতে কড়া মূল্য চুকাতে হয়েছে। এরপর ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সরকার মিলগুলো বেসরকারি মালিকানায় ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্তÍ গ্রহণ করে। ১৯৮২ সালে ৩৫টি মিল মালিকদের ফেরত দেয়া হয়। তখন খুলনার অ্যাজাক্স, সোনালী ও মহসেন জুট মিল আগের মালিকরা ফেরত পান। কয়েক বছর সেগুলো জোড়াতালি দিয়ে চালানো হলেও এক সময় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সালের ৩০ জুন বিশ্বের বৃহত্তম আদমজী জুট মিলের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। সবশেষ গত ৩০ জুন নন-জুট কারখানা তিনটিসহ ২৫টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জুট মিল সরকারি এক আদেশে বন্ধ করে দেয়া হয়।
বন্ধের এ সময়টা ছিল মোক্ষম। করোনায় সব মানুষ দিশেহারা এবং প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় ও সুযোগ কারও নেই। সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেই সাথে অবসান ঘটছে বিজেএমসি নামক সংস্থাটিরও। বন্ধের নোটিশ টানানোর পর দেশের সব মিলের মতো খুলনার মিলগুলোর শ্রমিক ব্যারাকের বাসিন্দারা একান্ত আপনজন হারানোর বেদনায় বুকফাটা কান্নার রুদ্ধ আবেগে শুধু অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। শ্রমিকরা আলাপের সময় বলেন, আমরা গগনবিদারী আহাজারি করতে পারিনি। তবে কারণ বলতে পারব না। এর আগে একবার পিপলস আর দৌলতপুর মিল বন্ধের সময় শ্রমিকরা অন্তত কেঁদে বুকের ব্যথা হালকা করতে পেরেছিলেন। এবার তাও পারেনি আর এভাবে ১৯৫০ সালে ইপিআইডিসির ব্যবস্থাপনায় যে পাটশিল্পের সগৌরব যাত্রা শুরু হয়েছিল, ৭০ বছর পর বিজেএমসির ব্যবস্থাপনায় নীরবে- নিভৃতেই তার অশ্রুসিক্ত অবসান ঘটল।


আরো সংবাদ



premium cement