২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শীর্ষ ১০ ব্যাংকের দখলে ৬৬ ভাগ খেলাপি ঋণ

-

ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের ৬৬ ভাগই শীর্ষ ১০ ব্যাংকের দখলে রয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়টি সরকারি ও চারটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে এসব ঋণ আদায় হয় না। বেশির ভাগ ঋণই কুঋণ বা মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এসব ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোর মামলা মোকদ্দমা করতে হয়েছে। এর ফলে মামলার বিপরীতে ব্যয় হচ্ছে ব্যাংকের অর্থ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নানাভাবে ছাড় দেয়া হচ্ছে ঋণখেলাপিদের। প্রচলিত নীতিমালা শিথিল করে কখনো ঋণ নবায়ন, ঋণ পুনর্গঠন, কখনো ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ নবায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করেও বছরের পর বছর পার পেয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণীর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তাদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ব্যবসার প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেমন, একজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাজারো ঝামেলা পেরিয়ে ১২ শতাংশ মুনাফা দিয়ে ব্যাংকের অর্থ সুদাসলে পরিশোধ করছেন। অপর একজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর কোনো রকম পরিশোধ না করেই ব্যবসা করছেন। ঋণপরিশোধকারী উদ্যোক্তার পণ্যের গড় উৎপাদনব্যয় আর ঋণ পরিশোধ না করা উদ্যোক্তার পণ্যের উৎপাদনব্যয় এমনিতেই অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। লোকসানের মুখে পড়ছেন অনেকেই। ফলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দেখে অনেক সময় প্রকৃত ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
একজন ব্যবসায়ী বলেন, সৎভাবে ব্যবসা করাও দেশে এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। অসৎভাবে ব্যবসা করলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু সৎভাবে ব্যবসা করলে ঘাটে ঘাটে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। আবার ব্যাংক থেকে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংক থেকেও তেমন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। অপর দিকে, বছরের পর বছর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপও নেয়া হয় না। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করাই যেন ওই সব ব্যবসায়ীর কাছে নিয়মে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মার্চ প্রান্তিকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৬৬ শতাংশই শীর্ষ ১০ ব্যাংকের বছরের পর বছর দখলে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংকের ১৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর পরেই অপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ১০ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে সমস্যাকবলিত বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। চতুর্থ অবস্থানে অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, পঞ্চম অবস্থানে রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ২৯১ কোটি টাকা, ষষ্ঠ অবস্থানে বেসরকারি খাতের নতুন প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংকের ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। সপ্তম ও অষ্টম অবস্থানে বেসরকারি খাতের অপর দু’টি ব্যাংকের ৩ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা ও ৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। নবম অবস্থানে সরকারি খাতের কৃষি ব্যাংকের ৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। আর দশম অবস্থানে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ২ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আলোচ্য ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রায় ৯০ ভাগই মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। তবে এর বাইরেও বিভিন্ন নামে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ রয়েছে ব্যাংকের। এর মধ্যে অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। যেসব ঋণ দীর্ঘ দিন ধরে আদায় হচ্ছে না ওই সব ঋণ ব্যাংকের আলাদা হিসাবে রাখা হয়। এসব আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ অবলোপন নামে ব্যাংকের খাতায় রাখা হয়। অপর দিকে, একশ্রেণীর উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নেয়ার জন্য তাদের খেলাপি ঋণ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করে সাময়িক সময়ের জন্য অব্যাহতি নেয়া হয়। উচ্চ আদালতে রিট করা এমন খেলাপি ঋণ রয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও নানা সময়ে নানা নামে খেলাপি ঋণ কখনো ১ শতাংশ, কখনো ২ শতাংশ আবার কখনো কোনো ডাউনপেমেন্ট না দিয়েই নবায়ন করা হয়। সবমিলেই ব্যাংকিং খাতে এখন খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর এক দিকে যেমন বিনিয়োগসক্ষমতা কমে গেছে, অপর দিকে ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এ অবস্থার উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোর সঙ্কট সামনে আরো বেড়ে যাবে বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।


আরো সংবাদ



premium cement