২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তলানিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ

ধীরগতিতে থাকা বিনিয়োগ করোনার জন্য এপ্রিলে নেমেছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে
-

বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ তলানিতে নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত এপ্রিলে এ খাতের বিনিয়োগ নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে। এটা এ যাবৎকালের সর্বনি¤œ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগে থেকেই নতুন বিনিয়োগে ধীরগতি ছিল। এর সাথে গত মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে মূলত বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যায়। নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা বিদ্যমান বিনিয়োগ চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। গত এপ্রিল থেকে বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকে। এতে চলমান বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়। এর বাইরে ব্যাংকগুলোতেও টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। গত দুই মাস ব্যাংকে টাকা জমার চেয়ে উত্তোলন হয় বেশি হারে। এতে ব্যাংকের অর্থব্যবস্থাপনা কঠিন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই থেকে বিনিয়োগ কমা শুরু হয়েছে। বিনিয়োগের এ নি¤œগতি আজো চলছে। প্রথমবারের মতো গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়। ওই মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে তা আরো কমে হয় ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে আরো কমে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশে আসে। এরপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো তলানিতে নেমে গেছে, যা এপ্রিলে এসেছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, সরকার এক লাখ কোটি টাকার ওপরে প্রণোদনা দিয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা নেই। আবার এ মুহূর্তে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ করলে সে অর্থ ফিরে পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। অপর দিকে, প্রণোদনার যে অংশটুকু পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে প্রদান করা হবে, ব্যাংক গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে ফেরত না পেলেও ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই অর্থ কেটে নেবে। সব মিলেই ব্যাংকগুলো এখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের সুবিধা নিতে চাচ্ছে না।
এ দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছরই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। ওই লক্ষ্যমাত্রায় বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়। চলতি অর্থবছরের জুন শেষে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য নীতিসহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু করোনার কারণে কোনো নীতিসহায়তাই কাজে আসছে না। ব্যাংকগুলো যাতে বেশি হারে বিনিয়োগ করতে পারে সে জন্য ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগসীমা বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোর তহবিল সঙ্কট মেটাতে নগদ জমার হার অর্থাৎ সিআরআর হার কমানো হয়েছে। স্বল্প সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যাতে ধার নিতে পারে সে জন্য রেপোর হার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর তহবিল সঙ্কট মেটাতে রেপোর মাধ্যমে যাতে বেশি হারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারে সে জন্য রেপোর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে ধার নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর পরও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বরং দিন দিন তা তলানিতে নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এত সুযোগ দেয়ার পরও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রথমত করোনার কারণে চলমান পরিস্থিতিতে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। না ব্যবসায়ী, না কোনো ব্যাংক, দুই পক্ষের কেউই এগিয়ে আসছে না। তবে কিছু কিছু ব্যবসায়িক গ্রুপ ঋণ নেয়ার জন্য ব্যাংকে ঘোরাঘুরি করছে, কিন্তু তাদের অতীত রেকর্ড ভালো না। অপর দিকে সুদহার বেঁধে দেয়া। বাজার অর্থনীতিতে সুদহার চাপিয়ে দেয়ার ফল ভালো হয় না। ব্যাংকাররা বলেন, ১৭-১৮ শতাংশ সুদহার যখন ছিল তখনও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এর অন্যতম কারণ হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা, পরিবেশ পরিস্থিতি, যারা তহবিল জোগান দেবেন তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনার নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করে। নানা কারণে দীর্ঘ দিন ধরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এর ওপর গত দেড়-দুই বছর যাবৎ সুবিধাবাদী এক শ্রেণীর ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবসায়ী গ্রুপ অসাধু উদ্দেশ্যে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যাংকিং খাতকে নিয়মনীতির মধ্যে চালানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। তারাই সুদহার চাপিয়ে দেয়ার জন্য সরকারকে ভুল পথ দেখাতে সহযোগিতা করে আসছে। এর ফলে ব্যাংকাররা বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। বেশির ভাগ ব্যাংক ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাচ্ছে না। নানাভাবে তারা উচ্চ সুদে আমানত গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করলে তাদের লোকসান দিতে হবে। এ কারণেই অনেকেই বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।
তাহলে ব্যাংকের বিনিয়োগ কোথায় যাচ্ছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে একজন এমডি বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের পরিবর্তে বেশি মুনাফার আশায় সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডেই বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। কারণ সরকারকে ঋণ দিলে এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি মুনাফা পাওয়া যায়। আর সরকারের ঋণ দেয়াটাও ব্যাংকগুলোর নিরাপদ বিনিয়োগ বলা চলে। কারণ এখানে খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ কারণেই ব্যাংকগুলো এখন ট্রেজারি বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। অপর দিকে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী গ্রুপ যারা ব্যাংক মালিক হয়েছেন তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে অন্যদের আর ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। এসব কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের এমন নি¤œগতি অবস্থা।


আরো সংবাদ



premium cement