১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঝালকাঠি থেকে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী হোগলা শিল্প

-

ঝালকাঠি শহরের সদর চৌমাথা (বায়তুল মোকাররম মসজিদের মোড়) থেকে লঞ্চ ঘাটের দিকে প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে সড়কের নাম স্টেশন রোড। সেখানে আধা কিলোমিটারজুড়ে হোগলা পাতার বুনানো হোগলা বিক্রির দোকান ছিল অনেক। যার কারণে ওই স্থানটির নামকরণ করা হয় হোগলা পট্টি।
জেলার চার উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বুনানো হোগলা নিয়ে এসে এখানকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করত। অন্য দিকে প্রয়োজনের তাগিদে জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ পাশের জেলা থেকেও ঝালকাঠির হোগলা পট্টি আসত হোগলা কিনতে। সেখান থেকে হোগলা কিনে বা ভাড়া নিয়ে এ শুকনো মৌসুমে জনসভা অথবা মাহফিলে বিছিয়ে জনসাধারণের বসার জন্য বিছানা করে দেয়া হতো। এ ছাড়াও ঈদুল আজহাসহ বিভিন্ন সময় গরুর গোশত কাটাকাটির কাজে হোগলা বিছিয়ে কাজ করা হতো। অপর দিকে মানুষ মারা গেলে তাকেও হোগল পাতার বুনানো হোগলা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হতো প্রাথমিকভাবে। তারপরে দাফনের সময়ও বাঁশ বিছানোর পরে হোগলা দিয়ে তার ওপর মাটি ফেলে দাফন কাজ শেষ করা হতো। অপর দিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কীর্তনসহ নানান পার্বনে হোগলার ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। কিন্তু সেই স্টেশন রোডের হোগলা পট্টিতে বর্তমানে একটিও হোগলা পাতার বুনানো হোগলা বিক্রির দোকান নেই। কালের পরিক্রমায় প্লাস্টিকের মাদুর আর পলিথিনের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে হোগলা পাতার বুনানো হোগলা। আগাছা পরিষ্কারের নামে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে হোগলা বন। জেলার হোগলা বন সংখ্যা অথবা কী পরিমাণ জমিতে হোগলা বন আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই জেলা বনবিভাগ ও কৃষি বিভাগে।
জানা গেছে, জেলার উপকূলীয় পরিবারের প্রায় বেশির ভাগ সদস্যই বংশপরম্পরায় হোগলা তৈরির পেশার সাথে জড়িত। কিন্তু বর্তমানে মহাজনদের দৌরাত্ম্য ও ডিজিটালের ছোঁয়ায় হোগলাপাতা চাষের জমি কমে এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক জোগানদাতা।
হোগলাপাতার ইংরেজি নাম সি-গ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস। উপকূলীয় এলাকার মানুষের কাছে এই হোগলা সংসারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাড়তি আয় রোজগারের একটি মাধ্যম। একসময় হোগলাপাতার ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল শুধু চাটাই তৈরিতে। সময়ের পরিবর্তনে এই পাতার নানা মাত্রিক ব্যবহার হচ্ছে। হোগলাপাতা দিয়ে বিছানা, দড়ি, ফ্লোরম্যাট, টেবিল, রান্নার সামগ্রী রাখার ঝুড়ি, লন্ড্রি বাসকেট, পেপার, ট্রে, ফলের ঝুড়ি, শোপিসসহ বিভিন্ন পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হতো। বেত ও বাঁশের চেয়ে দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এসব সামগ্রী তৈরিতে খরচও কম ছিল। পাশাপাশি পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় হোগলার দড়ি দিয়ে তৈরি নানা তৈজসপত্র। হোগলা শিল্পী রণজিৎ দাস, বালা রানী দাসসহ কয়েকজন জানান, একসময় হোগলার মাদুর ছিল শৌখিনতার প্রতীক। কিন্তু হোগলাপাতার সরবরাহ কম, আধুনিক পণ্যসামগ্রীর আধিপত্য ও প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। শীতের দিনে হিন্দু পরিবারগুলো হোগলার পণ্য তৈরির কাজে নেমে পড়ত সংসারের বাড়তি আয়ের আশায়। গ্রামের কৃষক, দিনমজুর, মুচিসহ অনেকেই এ পেশার সাথে জড়িত। এসব কুটির শিল্পীর অভিযোগÑ বর্তমানে হোগলাপাতার দাম বৃদ্ধি ও মজুরির ন্যায্যমূল্য তারা পাচ্ছেন না বিধায় এ কাজে তারা উৎসাহ হারাচ্ছেন। রাজাপুর উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া গ্রামের হোগলার কারিগর ফাতেমা বেগম জানান, সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হোগলাপাতার কাঁদি ডগা লাগানোর উপযুক্ত সময়। জমি চাষ দিয়ে তৈরি করে ছাই, গোবর বা সবুজ সার দিয়ে অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করা হোগলাপাতার কাঁদি ডগা এক-দেড় ফুট ফাঁকে ফাঁকে লাইন করে লাগানো হয়। ১৫-২০ দিন পর কাঁদি ডগার গোড়ায় গোড়ায় চারা গজাতে শুরু করে। এই চারা ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা হলে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে পাতা মোটা ও ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়। একবার কোনো জমিতে হোগলাপাতার চাষ করলে ওই জমিতে নতুন আর চারা লাগানোর দরকার হয় না। পৌষ মাসে পাতা কেটে ভালো করে রোদে শুকিয়ে আঁটি বাঁধা হয়। এরপর পাতার ওপরের অংশের মোটা আস্তর অংশ তুলে হোগলা বুনানোর কাজ শুরু হয়। সেই মোটা আস্তরকে দড়ি হিসেবে পান ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করেন।
তিনি আরো জানান, বাজারে সাধারণত পাঁচ হাত দৈর্ঘ্য ও চার হাত প্রস্থ হোগলার বিছানা তৈরিতে দুই থেকে তিন দিন লাগে। বর্তমানে একেকটি বিছানার দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আর দড়ি তৈরির জন্য বড় এক বান্ডেল হোগলাপাতার দাম ৩০০-৪০০ টাকা, যা থেকে সাড়ে ১০ হাজার ফুটের বেশি দড়ি তৈরি হয় এবং প্রতি ফুট দড়ির আঁটি ১০-১২ টাকা বিক্রি করা হয়। একটি বেতের বাসকেট তৈরিতে খরচ হয় ১২-১৩ শ’ টাকা, আর হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি করলে খরচ পড়ে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তা ছাড়া হোগলাপাতার ফুল বা রেণু সুস্বাদু খাবার হিসেবে মানুষ শখ করে খায়। এর গুঁড়া বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে হোগলার তৈরি নানা পণ্যসামগ্রীর কদর থাকলেও দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে হোগলা। হোগলাপাতার শিল্পের সাথে জড়িত স্থানীয় দরিদ্র পরিবারগুলোর কিছু সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আরো প্রসার ও পরিচিতি বাড়াতে পারলে দেশের সম্ভাবনাময় ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ও পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা এবং এ আয়ের পেশা টিকে থাকবে বলে মনে করে সচেতন মহল।


আরো সংবাদ



premium cement
শিবপুরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারীর নিহত চকরিয়ায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৩ গাজা মানবিক নরকে পরিণত হয়েছে : জাতিসঙ্ঘ প্রধান রাফা হামলার পরিকল্পনা ইসরাইলের ত্যাগ করা উচিত : চীন গাজা যুদ্ধে নতুন যে কৌশল অবলম্বন করল ইসরাইল হাসপাতালের শৌচাগারে মিলল নবজাতক শিশু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি

সকল