২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজধানীতে এবারো জলাবদ্ধতার আশঙ্কা

দখল-দূষণে স্থবির খাল
-

বাসাবো খাল ক্রমেই সরু হয়ে গেছে। খালের দুই পাশে দেয়াল নির্মাণ করে সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু খালপাড়ের অনেক স্থান প্রভাবশালীরা দখল করে দোকান, দলীয় কার্যালয় তৈরি করেছেন। সরেজমিন খালটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, পানির তেমন প্রবাহ নেই। ময়লা আবর্জনায় ভর্তি হয়ে গেছে। কবে এ খাল পরিষ্কার করা হয়েছে তা এলাকাবাসীও বলতে পারেন না। এভাবে রাজধানীর প্রায় সব খালই বর্তমানে দখল-দূষণে স্থবির হয়ে গেছে। ঢাকা ওয়াসা যে ২৬টি খাল পরিচ্ছন্ন করে থাকে তার মধ্যে এবার মাত্র সাতটি করেছে। বাকি ১৯টিতে তারা হাতই দিতে পারেনি। এসব খাল এখন ময়লার ভাগাড়। ফলে আসন্ন বর্ষায় রাজধানীর সড়কের পানি দ্রুত অপসারণ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে প্রতি বছরের মতো এবারো জলাবদ্ধতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ঢাকাবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু টেকসই সমাধানের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। শুধু মিটিং আর নির্দেশেই আটকে আছে এ সংক্রান্ত কাজ। এ অবস্থায় এবারো বর্ষা রাজধানীতে বড় দুর্ভোগের কারণ হতে পারে বলে শঙ্কায় আছেন নগরবাসী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খালগুলো অবৈধ দখল ও কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। নগরের খাল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও ব্রিক স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নদীতে যেতে পারছে না। ফলে ভারী বর্ষণে শহরের অলিগলি প্রধান সড়ক, ফুটপাথ পর্যন্ত তলিয়ে যায়। এ সময় খানাখন্দে ভরা সড়কে চলাচলে প্রতি বছরই দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপরও জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
তারা বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সরকারের পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার করা হয়। দফায় দফায় সভা হয়, এরপর সবাই বেমালুম ভুলে যান। ফের বর্ষা মৌসুম এলে কিছুটা তোড়জোড় হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে রুটিন কিছু কাজ হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, ড্রেন সংস্কার ও নতুন করে কিছু ড্রেন নির্মাণ ইত্যাদি। কিন্তু এতে জলাবদ্ধতা নিরসনে তেমন কোনো সুফল মেলে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো বলছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে; তাতে টেকসই সমাধান হবে না। এতে সাময়িক কিছুটা সমাধান হবে, স্থায়ী কিছু নয়। সমস্যার সমাধানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো: তাজুল ইসলাম ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দু’টি প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আবারো সভা করার কথা জানান। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। ২৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় চট্টগ্রাম শহরের খাল উদ্ধার কার্যক্রমের আদলে কোনো সামরিক সংস্থাকে দিয়ে এ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী মো: তাজুল ইসলাম বলেন, এবারের বর্ষায় ঢাকা শহরে যাতে কোনো ধরনের জলাবদ্ধতা না হয়; সে জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসাকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ইতোমধ্যে তাদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তাদের কার্যক্রম আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি আরো বলেন, শহরের জলাবদ্ধতার টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে দুই সিটি করপোরেশনকে দুটো প্রকল্প গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরের দখলদার উচ্ছেদ করে জলাবদ্ধতার টেকসই সমাধান মিলবে বলে আশা করি। এর মধ্যে সচিবালয় এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে শিক্ষাভবন থেকে সচিবালয়ের তিন দিক ড্রেন নির্মাণকাজ চলছে। এসব ড্রেন ওয়াসার কালভার্ট রোডের ড্রেনের সাথে সংযোগ দেয়া হবে। এ ছাড়া একটি অংশ ওসমানী উদ্যানের লেকের সাথেও সংযোগ দেয়া হবে।
এ দিকে ওয়াসার পরিচালক (টেকনিক্যাল) মো: সহিদ উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে জানান, এখন পর্যন্ত আমরা সাতটি খালের সলিড ওয়েস্ট পরিষ্কার করতে পেরেছি। বাকি ১৯টির কাজ এখনো করতে পারিনি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার শুরু হবে। তিনি বলেন, ২৬টির মধ্যে ২৪টি খালের সলিড ওয়েস্ট অপসারণের পাশাপাশি আমরা খননেরও উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া ওয়াসার উদ্যোগে এ বছর নিকুঞ্জতে ড্রেন করা হয়েছে। মিরপুর এলাকাতে ড্রেন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সলিড ওয়েস্ট আগে থেকেই যদি সিটি করপোরেশন পরিষ্কার করত তাহলে খালে এত সলিড ওয়েস্ট হতো না। তিনি জানান, ওয়াসার চারটি পয়েন্টে বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য পাম্প রয়েছে। টিটিপাড়ার জনপথে যে স্টেশন রয়েছে সেখানে তিনটি পাম্প রয়েছে। এর একটি পাম্প দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ হাজার লিটার পানি অপসারণ করা যায়।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো: আসাদুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসার। কিন্তু তারা গত কয়েক বছর ধরে কোনো ড্রেনই নির্মাণ করে না। এ কারণে সিটি করপোরেশনকে এখন ড্রেন নির্মাণ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া তাদের পানি পাম্পের যে সক্ষমতা রয়েছে তা দিয়েও অধিক বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসন সম্ভব নয়। এ দিকে সর্বশেষ গতকাল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ঢাকার খালগুলো পরিচ্ছন্নতার জন্য ওয়াসাকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আবারো জোর তাগিদ দেন।
জানা গেছে, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি প্রকল্পের উন্নয়নকাজের কারণে রাজধানীর অনেকাংশে পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে এবারের বর্ষায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহরূপ ধারণ করতে পারে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেট্রোরেল উন্নয়নকাজের কারণে মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও তালতলা পর্যন্ত ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছে। এগুলোর সংস্কার এখনো শুরু হয়নি। এ ছাড়া বিজয় সরণির ‘বিমান চত্বর’ থেকে খামারবাড়ি হয়ে কাওরানবাজার পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো। ওই ড্রেনেজ সংস্কার করে দেয়ার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এতে তারা সিটি করপোরেশনকে ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু, গত দুই মাসেও টাকা দেয়নি। বর্ষা আসন্ন হলেও কোনো কাজ করতে পারছে না বলে ২৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুষ্ঠিত সভাকে অবহিত করা হয়। এতে বলা হয়, টিসিবি ভবনসংলগ্ন ওয়াসার ড্রেনেজ ছিল; যেখান থেকে পানি হাতিরঝিলে যেত। সে সময়ে কাওরানবাজারে কোনো জলাবদ্ধতা হতো না। এখন পানি নিষ্কাশন ড্রেন ঘুরিয়ে দেয়ায় হাতিরঝিলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এবার বর্ষার আগে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষ টিসিবি ভবনের সামনের পানি নিষ্কাশন গেটগুলো খুলে না দিলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। এ ছাড়া হাতিরঝিলে সরাসরি পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে দেয়ায় মগবাজার নয়াটোলা ও মগবাজার প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
ওই সভায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের সামগ্রিক কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। এখন পর্যন্ত সমন্বিত কোনো মাস্টারপ্ল্যানও তৈরি করা হয়নি। শহরের এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সমাধান করে জলাবদ্ধতা নিরসনে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার মধ্যে রয়েছেÑ সচিবালয়, মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, নিকুঞ্জ-১ ও ২, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রোকেয়া সরণি, সাংবাদিক কলোনি এলাকা।
সূত্র জানায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এতে উত্তর সিটির পক্ষ থেকে টেকসই সমাধানের প্রস্তাব দেয়া হয়। ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো: শরীফ উদ্দিন বলেন, এটা কঠিন কাজ, বেসামরিক কোনো সংস্থা দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ জন্য চট্টগ্রাম শহরের খাল উদ্ধার কার্যক্রমের আদলে কোনো সামরিক সংস্থাকে দিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। ওই সভায় ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো: জামাল মোস্তফা বলেন, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পরামর্শ অত্যন্ত যৌক্তিক। আমি মনে করি, ঢাকার চারপাশের নদী এবং শহরের ভেতরের খালগুলোর সমন্বয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে তেমন কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, ড্রেন করে তো জলাবদ্ধতা নিরসন করা যাবে না। সরকারের উচিত শহরের খালগুলো দখলমুক্ত করে প্রবাহ নিশ্চিত করা। একই সাথে দুই সিটি করপোরেশনকে কঠিন বর্জ্য সঠিকভাবে অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো পানি নিষ্কাশনে বড় বাধা হয়ে দঁড়াাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি চারপাশের নদীতে পৌঁছাতে ড্রেন-খাল ও নদীর সাথে কার্যকর সংযোগ থাকা দরকার। বাস্তবতা হচ্ছে সেটা নেই। শহরের খালগুলো দখলমুক্ত এবং খাল ও ড্রেনে কঠিন বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা গেলে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য ড্রেন-নদী ও খালের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করা কঠিন বলে সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা নিতে চায় না। এ জন্য এ প্রকল্পের কাজ সামরিক বাহিনীকে দেয়ার প্রস্তাব উঠেছে। এটা যৌক্তিক, সামরিক বাহিনীকে এ দায়িত্ব দেয়া হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement