২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বায়ুদূষণে মানুষের গড় আয়ু কমছে দুই বছর

-

দেশে মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু প্রায় দুই বছর করে কমছে। বায়ুদূষণে মানুষের মধ্যে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ছে। নগরায়নের প্রতিযোগিতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া, বাতাসে সিসার পরিমাণ। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত বিরূপতায় খরা, বন্যা, ঝড়, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পসহ আমাদের নানা ধরনের ভয়াবহ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ রোধে সবুজ গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; কিন্তু শহরে দূষণ বাড়ার সাথে সাথে কমে আসছে সবুজ গাছপালা। যানবাহনের ক্ষতিকর গ্যাস ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মাত্রাতিরিক্ত দূষণে বিশেষ করে ঢাকা শহরের গাছপালা টিকে থাকার ক্ষমতাও হারাচ্ছে। ফলে দিন দিন মানুষের বিপদ বাড়ছে।
পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজ। গত আট বছরে বায়ুদূষণের এই তিন উৎস ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে দূষণের ভয়াবহতা। বায়ুদূষণ মোকাবেলায় প্রধান কাজ হচ্ছে দূষণের উৎসগুলো বন্ধ করা।
সরকারের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক জরিপে বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে একজন মানুষ ২২ মাস আগে মারা যায়। তার মানে বায়ুদূষণ না থাকলে প্রতিটি মানুষ দুই বছর বা ২২ মাস বেশি বাঁচতে পারত।
ঢাকায় ৯৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩১ ওয়ার্ডকে বাছাই করে বিআইডিএস তথ্য সংগ্রহ করে। পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঢাকায় বসবাসরত মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ বায়ুদূষণজনিত রোগে ভুগছে। এরই মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত ৮ শতাংশ। এ ছাড়া সরাসরি বায়ুদূষণজনিত কারণ নয়, কার্ডিয়াক সমস্যায় ভুগছে ৮ শতাংশ, আর ক্যান্সার আক্রান্তের হার ১.৩ শতাংশ।
বায়ুদূষণ পরোক্ষে এ দু’টি রোগে আক্রান্ত হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে; কিন্তু কেন এ পরিণতি হলো। কারণ ঢাকা যেভাবে বেড়ে উঠেছে সেভাবে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সমীক্ষায় বলা হয়, চার শ’ বছরের এ রাজধানী ঢাকা শহরের একটা বড় অংশজুড়ে ছিল বিভিন্ন গাছ। পরিকল্পনা করেই পিচ রাস্তার ধারে লাগানো হয়েছিল গাছগুলো।
এখনো যেখানে যেখানে গাছ বেশি, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকায় দূষণ কিছুটা কম। ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অনেক গাছ এবং সেখানে দূষণ সম্ভবত সবচেয়ে কম। কিন্তু নতুন নতুন যেসব আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে সেভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির তেমন কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। কারণ ঢাকা যেভাবে বেড়ে উঠেছে সেভাবে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
এ ছাড়া দেশে জনসংখ্যার চাপ ও নগরায়নের প্রতিযোগিতায় বাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া, বাতাসে সিসার পরিমাণ। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত বিরূপতায় খরা, বন্যা, ঝড়, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পসহ নানা ধরনের ভয়াবহ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে এ দেশকে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে একমাত্র গাছই পালন করে উপকারী বন্ধুর ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, গাছের পাতার পৃষ্ঠগুলো বাতাসের অতিক্ষুদ্রকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ দূষণকারী উপাদান শোষণ করে। এসব ক্ষতিকর উপাদান শোষণে গাছের পত্ররন্ধ্র বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে গাছের পাতার ক্লোরোফিলের সংখ্যা হ্রাস পায়। পত্ররন্ধ্রের খোলা ও বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। অন্য দিকে সালফার ডাই-অক্সাইড পানির সাথে মিশে সালফিউরিক এসিড তৈরি করে, যা ক্লে¬ারোফিলের প্রধান উপাদান ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ হ্রাস করে। এর ফলে পাতা বিবর্ণ হতে থাকে। আকার-আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। গাছের ফুল-ফল ধারণক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যায় এবং গাছ মারা যায়।
ঢাকা শহরের সবুজ অঞ্চলের পরিমাণ নিয়ে জাপানের কিয়াটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বাংলাদেশের তিন গবেষকের মতে, ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল মোট আয়তনের ১২ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮ শতাংশে। বর্তমান ঢাকা শহরে সবুজ অঞ্চল ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হবে না। তাহলে কিভাবে ভালো থাকবে ঢাকার বাতাস? এভাবে প্রকৃতি রক্ষার আসল বন্ধু গাছ হারিয়ে যাওয়াতে দিন দিন মানুষের জীবনে ঝুঁকি বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কমপক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বাতাসে বিষ কমবে। বায়ুমণ্ডল ১০০ বছরের আগের মতো হবে। গবেষণায় বলা হয়, শুধু গাছ লাগালেই জীবন বাঁচবে। তা না হলে যে হারে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে ফুলে-ফেঁপে ওঠা সমুদ্রের পানিতেই তলিয়ে যেতে হবে আমাদের। কারণ উষ্ণায়নের জেরে বরফ গলছে অস্বাভাবিক দ্রুত হারে। আর বিশ্বজোড়া শিল্পায়নের দৌলতে বাতাস ভয়ঙ্করভাবে বিষিয়ে উঠছে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ নানা ধরনের গ্রিন হাউজ গ্যাসে, যা তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর।

 


আরো সংবাদ



premium cement