২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনায় ৪৬০ কোটি টাকার হিমায়িত পণ্যের চুক্তি বাতিল

পড়ে আছে এক হাজার কোটি টাকার পণ্য
-

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে দেশের শতভাগ রফতানিমুখী খাত হিমায়িত চিংড়ি ও মাছের ৪৬০ কোটি ৬১ লাখ টাকার বিক্রয়চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। প্রায় এক হাজার কোটি টাকার প্রক্রিয়াজাত পণ্য অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড্স এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)- সরকারের কাছে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণসহ ঋণ সুবিধার দাবি জানিয়েছে।
বিএফএফইএর প্রেসিডেন্ট কাজী বেলায়েত হোসেন গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা ২০০৮ সাল পর্যন্ত নানাবিধ বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে রফতানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ২০০৮ সালের বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দায় আমাদের মওজুদকৃত হিমায়িত পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ায় রফতানিকারকদের তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়। সরকার নীতিগতভাবে এটি স্বীকার করে রফতানিকারকদের সিসি, প্লেজ ও হাইপো ঋণের ৩০ শতাংশ টার্ম লোন [সরকার (৩%) +রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান (১১%)] অর্থাৎ ১৪ শতাংশ সুদে ৮ বছরে পরিশোধ করার শর্তে টার্ম লোন প্রদান করেন। সরকারের এই উদ্যোগে আমরা ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত রফতানি ৬৩৮.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করি। তিনি বলেন, ২০১৪-১৫ সালে ইউরো, পাউন্ড, রুবল এবং ইয়েন-এর দরপতন হওয়ায় পুনরায় আমদানিকারক দেশে হিমায়িত চিংড়ি ও মাছের মূল্য হ্রাস পায়। ফলে আমাদের মজুদকৃত পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য কমে যায় এবং হ্রাসকৃত মূল্যে রফতানি করে আমাদের দ্বিতীয় দফায় মূলধনের প্রায় ৫০ শতাংশ ঘাটতি হয়। ওই সময় রফতানিকে সচল রাখার জন্য সরকার পুনরায় ১১ শতাংশ (সরকার ৩% ও ঋণ গ্রহীতা ৮%) সুদে ঋণ প্রদানকারী সংস্থাকে তাদের নিজ নিজ ঋণগ্রহীতার প্লেজ ও হাইপো ঋণের বিপরীতে ৩০ শতাংশ টার্ম লোন ৫ বছর মেয়াদে পরিশোধ করার নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে কম উৎপাদন ব্যয়ের মাধ্যমে অধিক ফলনশীল ভ্যানামি প্রজাতির চিংড়ি হ্রাসকৃত মূল্যে আন্তর্জাতিক বাজারে বাজারজাত করার ফলে আমরা তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হই। আমাদের দেশে ভ্যানামি চিংড়ির উৎপাদন না থাকায় এবং বাগদা চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর দরপতন ঘটে। এমতাবস্থায় আমাদের হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলো ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রচুর লোকসান দিয়েও অতি প্রয়োজনীয় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে রফতানি কার্যক্রম চালু রাখি। ফলে আমাদের কিছু কারখানা বিভিন্ন সময়ের টার্ম লোন ও হাইপো, প্লেজ ঋণের সুদে জর্জরিত হয়ে ঋণখেলাপি হয়ে রুগ্ণশিল্পে পরিণত হয়। এই রুগ্ণ-এর আরো একটি অন্যতম কারণ কাঁচামালের সঙ্কট। আমাদের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ মাত্র ১৫ শতাংশ। যার ফলে ঙাবৎযবধফ ঈড়ংঃ কোনো মতেই পূরণ করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের ১০৫টি হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও মাত্র ৩০-৩৫টি কারখানা রফতানিতে সক্রিয় আছে, যাদের প্রায় সবাই দায়দেনাগ্রস্ত। কোনো মতে উৎপাদন ও রফতানিতে নিয়োজিত আছে। এ অবস্থার মধ্যেই হঠাৎ জানুয়ারি, ২০২০ থেকে বিশ^ব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারে যেন আমাদের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমাদের পণ্য পচনশীল, যা গুণগত মানসম্মত থাকা অবস্থায় বিক্রি করতে হয়। বিশ^ব্যাপী এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রভাব উত্তরণের পরে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য কত হ্রাস হবে বা কী পরিমাণ পণ্য রফতানির উপযোগী থাকবে, তা এখনই নির্ণয় করা যাবে না। তবে ২০০৮ সালে বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দা ও ২০১৪-২০১৫ সালের আমদানিকারী দেশগুলোর ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন ও রুবল-এর দরপতনের সময় অবিক্রীত মওজুদ পণ্যের মূল্য প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। বর্তমানে এলসি ও বিক্রয় চুক্তি বাতিল হওয়ায় আমাদের রফতানিতে নিয়োজিত কারখানাগুলোর যে পরিমাণ চলতি মূলধন ছিল, তাও মওজুদকৃত পণ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে প্রায় সব কারখানাই বর্তমানে তারল্য সঙ্কটে নিপতিত।
তদুপরি চলতি মার্চ, ২০২০-এ বাগদা চিংড়ির মওসুম শুরু হয়েছে, যা অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় কৃষকদের ঘের থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে আহরণ করতে হয় এবং এক গোণের চিংড়ি আহরণ না করলে পরবর্তী গোণ পর্যন্ত অধিকাংশ চিংড়ি মারা যায়। যা বাগদা চিংড়ির ক্ষেত্রে একটি চিরাচরিত চিত্র। তা ছাড়া এই অতি উচ্চ মূল্যবান চিংড়ি মাছ ঘেরে ৫০-৬০ গ্রেডে আসলেই চিংড়ি চাষি তা আহরণ করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কারণ অনেক সময় ভাইরাসেও চিংড়ি মারা যায়। চাষিদের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সহযোগিতা দান, প্রধানমন্ত্রীর ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে রফতানি কার্যক্রম চালু রেখে অতি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং এ খাতে নিয়োজিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬০ লাখের বেশি লোকের জীবিকা অর্জন নিশ্চিতকরণের জন্য রফতানি কার্যক্রম চালু রাখার বিকল্প নেই। কাজী বেলায়েত উদ্দিন সরকার ও ঋণ প্রদানকারী সংস্থা (ব্যাংক, সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান) যৌথ উদ্যোগে নিজ নিজ ঋণ গ্রহণকারী চালু হিমায়িত মৎস্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সব ঋণের ওপর ৩০ শতাংশ সুদবিহীন ঋণ প্রদান, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে অবিক্রীত মওজুদকৃত পণ্যের ওপর ১ জানুয়ারি, ২০২০ থেকে পরবর্তী দুই বছরের সুদ মওকুফ, এই সঙ্কটময় মুহূর্তে সব ধরনের ঋণের সুদের কিস্তি, শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন ও বিদ্যুৎ বিল ব্যাংক ঋণের লিমিটের অতিরিক্ত হলেও ব্যাংক থেকে উত্তোলন করার অনুমোদন, অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতো হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রফতানিতে ১০ শতাংশের স্থলে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদান করার অনুরোধ জানান।

 


আরো সংবাদ



premium cement