২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মক্কা-মদিনায় বাংলা কমিউনিটি স্কুল আর্থিক সঙ্কটে বন্ধের উপক্রম

-

সৌদি আরবের মক্কা-মদিনার বাঙালি কমিউনিটি স্কুল আর্থিক সঙ্কটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এরই মধ্যে মক্কার স্কুলটির কার্যক্রম একবার বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় তিনটি ভাড়া বাসায় ঘরোয়াভাবে চালু রাখা হয়েছে। সৌদি সরকারের নতুন করারোপের ফলে প্রবাসীদের দেশে ফেরার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে শিক্ষার্থী কমে আসায় স্কুলগুলোর আয় হ্রাস পেয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহযোগিতা না পেলে দু’টি স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, মক্কা ও মদিনার বাংলা স্কুলের শিক্ষাকার্যক্রম যেকোনো মূল্যে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী দূতাবাসের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
গত সপ্তাহে ওমরাহ পালন করতে যাওয়া বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে মক্কার বাংলাদেশ হজমিশনে মতবিনিময়কালে তিনি আরও জানান, সৌদি আরবে অবস্থিত ৯টি স্কুলের মধ্যে বর্তমানে মক্কার বাংলা স্কুলটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। স্কুলটির পাঠদানের অনুমতি থাকলেও স্কুলটিকে এখনো সরকারি আর্থিক সহযোগিতা দেয়া যায়নি। সৌদি আরবে বাংলা স্কুলগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রবাসী কল্যাণ তহবিল থেকে ১০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
মক্কায় বাংলা কমিউনিটি স্কুলের প্রধান পরিচালক ও পৃষ্ঠপোষক আব্দুল জব্বার জানান, মক্কার বাংলা কমিউনিটি স্কুলটির ছাত্র সংখ্যা ২০১৮ সালেও এক হাজার ১০০ জন ছিল। ভাড়া করা ভবনে অত্যন্ত সুন্দরভাবেই পাঠকার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সৌদি সরকার প্রবাসীদের ওপর নানা ধরনের করারোপ করায় অনেক প্রবাসী পরিবার সৌদি আরব ত্যাগ করে। এতে ছাত্র সংখ্যা কমে যায়। যারা পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন তারাও সহযোগিতা দিতে অপারগ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় আর্থিক সঙ্কটের কারণে স্কুলটির কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে আবার নতুন করে ভাড়া বাসায় চালু করতে হয়। অনেক শিক্ষককে বিদায় করে দিতে হয়। আর ছাত্র সংখ্যাও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে মক্কার তিনটি পাহাড়ি এলাকার বাসায় ঘরোয়াভাবে ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলটি পরিচালিত হচ্ছে। স্কুলটির পাঠদানের অনুমোদন রয়েছে এবং গত বছরও অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় স্কুলটির শিক্ষার্থীরা জেদ্দায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলও ভালো।
তিনি বলেন, সৌদি সরকারের আইন অনুযায়ী মক্কায় স্কুলের জন্য নিজস্ব জমি কেনার কোনো সুযোগ নেই। তবে সৌদি আরবে স্থানীয় কোনো স্কুলের সাথে যৌথভাবে স্কুল পরিচালনার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ওই স্কুল ভবন ব্যবহারের জন্য বছরে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সেই ভাড়ার অর্থ স্কুলের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিয়ে কোনোভাবেই পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তবে স্কুলটির কেন্দ্র অনুমোদনসহ সরকারের আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার জন্য সব রকমের প্রচেষ্টা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি সফররত সাংবাদিকদেরকে স্কুলটির কার্যক্রম ঘুরে দেখান। তাতে দেখা যায়, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তিনটি ভাড়া বাসায় ড্রয়িংরুমে পর্যায়ক্রমে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করা হচ্ছিল, যা কোনোভাবেই স্কুলের পাঠদানের উপযোগী নয়।
আব্দুল জব্বার জানান, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বেতন এবং বাসা ভাড়া পরিশোধের টাকাও শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে আসছে না। এই অবস্থায় সরকারের আর্থিক সহায়তা না পেলে স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই সৌদি আরবের অন্য স্কুলের সাথে যৌথভাবে স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে সৌদি সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন বাংলাদেশ সরকার স্কুলের ভবন ব্যবহারের ভাড়াসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করলে মক্কার স্কুলটির কার্যক্রম আগের মতোই সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। গত প্রায় দেড় যুগ ধরে তিনি মক্কার বাংলা কমিউনিটি স্কুলটির কার্যক্রম পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বলেও জানান। তিনি বলেন, স্কুলটি পরিচালনায় সব সময় দলমত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা পেয়েছি। তবে স্কুলটি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা বড় ফ্যাক্টর।
পবিত্র মদিনায় অবস্থিত বাংলা কমিউনিটি স্কুলটির নাম মদিনা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। স্কুলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুসা আব্দুল জলিল জানান, এই স্কুলটিতে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল; কিন্তু বর্তমানে তা কমে ১০০ জনের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া প্রবাসীরা দেশে ফেরার প্রবণতা বৃদ্ধিতে শিক্ষার্থী কমে গেছে বলে তিনি জানান। মদিনার শোরান রোডের র্আরাওধাবিতে সৌদি আরবের একটি আরবি স্কুলে বাংলা স্কুলটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে বিকেলের শিফটে। এ জন্য স্কুলটির কর্তৃপক্ষকে বছরে দেড় লাখ সৌদি রিয়াল পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই ভাড়ার অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু এ বছর সেই ভাড়া পরিশোধ করা না গেলে স্কুল পরিচালনাকারীদের পক্ষে এই অর্থ পরিশোধকরা দুঃসাধ্য বলে তিনি জানান। সরকারের আর্থিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় স্কুলটির কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সৌদি আরবের স্থানীয় স্কুলেই অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে প্রশস্ত ও পরিপাটি শ্রেণী কক্ষে বাংলাদেশী স্কুলটির পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্কুলটির ছাদে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলাসহ বিনোদনের সব ব্যবস্থা রয়েছে। স্কুলটিতে প্লে থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী রয়েছে। সৌদি আরবের নিয়ম অনুযায়ী ছাত্র ও ছাত্রীদের আলাদাভাবে পাঠদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সঙ্কটের কারণে একই সাথে একাধিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতেও দেখা গেছে। ৯ জন শিক্ষকের অধিকাংশই নারী। মুসা আব্দুল জলিল জানান, মদিনার বাংলা স্কুলটির পরীক্ষাকেন্দ্রেরও অনুমোদন রয়েছে। ২০১৯ সালে অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৩ জন। ২০০৯ সাল থেকে স্কুলটির কার্র্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
প্রসঙ্গত, সৌদি আরবে ৯টি বাংলাদেশী কমিউনিটি স্কুল রয়েছে। সেগুলো হলোÑ রিয়াদ বাংলা মিডিয়াম ও ইংলিশ ভার্সন স্কুল, জেদ্দা বাংলা ও ইংলিশ ভার্সন স্কুল, দাম্মাম ইংলিশ ভার্সন স্কুল, আলকাছিম বুরাইদা বাংলা স্কুল, তাবুক বাংলা স্কুল, মক্কা বাংলা স্কুল ও মদিনা বাংলা স্কুল।
রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ জানান, মক্কা-মদিনার বাইরে বাংলাদেশী স্কুলগুলোর অবস্থা তুলনামূলক ভালো। প্রায় সবগুলো স্কুলকেই প্রধানমন্ত্রীর বরাদ্দ টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে। মক্কা-মদিনার স্কুল দু’টিকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্কুল পরিচালনাকারীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement