২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রতিষ্ঠাতা-দাতা বাদ দিয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের নতুন নাম হচ্ছে

-

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় একটি কলেজ এবং একটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে একটি ছাত্র ও একটি ছাত্রী হলের নামও। পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী আরো দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
২০১৮ সালে উল্লাপাড়া কলেজ ও ২০১৯ সালে হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে এইচ টি ইমাম কলেজ এবং এইচ টি ইমাম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামকরণ করা হয়েছে। হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ১৯৬৩ সালে এবং উল্লাপাড়া কলেজ ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ছাত্র ও ছাত্রী হলের নামকরণ করা হয়েছে উল্লাপাড়ার বর্তমান এমপি ও এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম ও তার স্ত্রী মাহিম ইমামের নামে। অন্য দিকে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯৮৪ সালে সরকারীকরণকৃত ‘সরকারি আকবর আলী কলেজ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘শেখ রাসেল সরকারি কলেজ’ এবং উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজের সহযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মোমেনা আলী বিজ্ঞান স্কুল’-এর নামকরণ ‘ইসমাত ইমাম বিজ্ঞান স্কুল’ করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজের আকবর আলী হলের (২০০৫) নাম পরিবর্তন করে ২০১৯ সালে ‘তানভীর ইমাম হল’-নামকরণ করা হয়েছে। একই কলেজের ‘মোমেনা আলী ছাত্রী হলের’ (২০০৩) নাম পরিবর্তন করে ২০১৯ সালে এমপি তানভীর ইমামের স্ত্রী ‘মাহিম ইমাম ছাত্র হল’ করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উল্লাপাড়ার সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আকবর আলী কলেজ ও রাজশাহী বোর্ডের অন্যতম সেরা স্কুল মোমেনা আলী স্কুলের নাম পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টির প্রতিষ্ঠাতা উল্লাপাড়ায় বিএনপির সাবেক এমপি (১৯৯১ ও ২০০১) এম আকবর আলী। তিনি ১৯৭০ সালে নিজের নামে ‘আকবর আলী কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৮৪ সালে সরকারীকরণ হয়। এই কলেজের নাম পরিবর্তন করে শেখ রাসেল সরকারি কলেজ এবং আকবর আলীর স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত ‘মোমেনা আলী বিজ্ঞান স্কুল’-নাম পরিবর্তন করে তানভীর ইমাম এমপির মা ‘ইসমাত ইমাম বিজ্ঞান স্কুল’ নামে নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী-এর কাছে মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গত ৬ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মুর্শিদা শারমিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী (চেয়ারম্যানের দফতর) বরাবর পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘...সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলাধীন সরকারি আকবর আলী কলেজ-এর নাম পরিবর্তন করে শেখ রাসেল সরকারি কলেজ’ নামে নামকরণের বিষয়ে মতামতসহ প্রস্তাব প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
একইভাবে গত বছরের ২৯ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহীর চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়ে নাম পরিবর্তনের মতামত চেয়ে চিঠি দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব আনোয়ারুল হক। চিঠিতে বলা হয়, ‘...সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলাধীন মোমেনা আলী বিজ্ঞান স্কুল-এর নাম পরিবর্তন করে ইসমাত ইমাম বিজ্ঞান স্কুল নামে নামকরণের বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এ দিকে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য (১৯৯১ ও ২০০১) এম আকবর আলী শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা ও আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। তবে এ দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক এমপি এম আকবর আলী নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা ও আপত্তি জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন।
সরকারি আকবর আলী কলেজের নাম পরিবর্তনের প্রতিবাদ ও আপত্তি জানিয়ে দুই দফায় শিক্ষা সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক) বরাবর আবেদন করেন প্রতিষ্ঠাতা এম আকবর আলী। এতে তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় ১৯৭০ সালের আগে কোনো কলেজ ছিল না। আমার উদ্যোগে এবং অর্থায়নে এলাকার বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তিবর্গ ও জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় ১০.৩২ একর জমি ক্রয় করে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আমার নাম ‘আকবর আলী কলেজ’ নামে নামকরণ করা হয় যা ১৯৮৪ সালে সরকারীকরণ করা হয়। বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ নীতিমালা অনুযায়ী এবং মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের পত্র নম্বর ৯৩২৩-সি তারিখ ২৭-১২-১৯৮৪-এর নির্দেশ মোতাবেক কলেজের গভর্নিং বডি একটি রেজিস্ট্রি হেবা দলিলের শর্ত মোতাবেক কলেজের যাবতীয় সম্পদ সরকারের বরাবর হস্তান্তর করা হয়। এতে আরো বলা হয়, দলিলের অন্যান্য শর্তাবলির মধ্যে ৫ নম্বর শর্তানুযায়ী কলেজের বর্তমান নামকরণ বহাল রেখে ‘সরকারি আকবর আলী কলেজ’ নামকরণ করা হয়। ১৯৮৪ সাল হতে এ নামেই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে।
সিরাজগঞ্জ এবং আশপাশের কয়েকটি জেলার বেসরকারি কলেজ থেকে সরকারি হওয়া বেশ কিছু কলেজের নাম উল্লেখ করে আকবর আলী বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান পূর্বের নাম বহাল রেখেই সরকারীকরণ হয়েছে এবং কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। তিনি বলেন, ৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান সরকারি আকবর আলী কলেজ যা ৩৬ বছর আগে সরকারীকরণ করা হয়েছে। হঠাৎ এর নাম পরিবর্তন করে ‘শেখ রাসেল কলেজ’ নামকরণ করার প্রস্তাব অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জনগণ মনে করে। এ ধরনের চেষ্টা কলেজ জাতীয়করণের সময় রেজিস্ট্রিকৃত হেবা দলিলের ৫ নম্বর শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনও বটে। এ অবস্থায় কলেজের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব গ্রহণ না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারের কাছে তিনি জোর দাবি জানান।
মোমেনা আলী বিজ্ঞান স্কুলের নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা ও আপত্তি জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা এম আকবর আলী। এতে বলা হয়, উল্লাপাড়ায় একটি বেসরকারি উচ্চমানসম্পন্ন কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে (তখন তিনি এমপি) নিজ অর্থায়নে ১.৭৬ একর জমি কিনে এই জমির ওপর আমার এবং আমার স্ত্রী মোমেনা আলীর উদ্যোগে ও অর্থায়নে ১৯৯৪ সালে ‘উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি। ২০০২ সালে কলেজের গভর্নিং বডির সভায় মানসম্মত শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে আলোচনাকালে কলেজের শিক্ষকমণ্ডলীর মতামতের ভিত্তিতে কলেজের সাথে স্বতন্ত্র স্কুল শাখা খোলার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী এবং পরবর্তীতে এসএসসি পর্যন্ত করা হয়। ২০০৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গভর্নিং বডির সভায় কলেজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজ চত্বরে দাতা সদস্য মোমেনা আলীর নামে স্কুলটির নামকরণ করা হয়। মোমেনা আলী (আকবর আলীর স্ত্রী) স্কুল প্রতিষ্ঠায় ৬ লাখ টাকা দান করেন।
আবেদনে আরো বলা হয়, ব্যক্তির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে বিধিবিধান ও শর্তাবলি আছে, সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকালীন সময় পূরণপূর্বক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনক্রমেই ‘মোমেনা আলী বিজ্ঞান স্কুল’ নামকরণ (২০০৩ সাল) করা হয়েছে। বর্তমান এমপি সাহেবের ইচ্ছায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক স্কুলের নাম পরিবর্তন করে (ইসমাত ইমাম বিজ্ঞান স্কুল) বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন। প্রবিধিমালা-২০০৯ প্রবিধানে বর্তমান কমিটির স্কুলের নাম পরিবর্তন করার ক্ষমতা নাই বিধায় প্রস্তাবটি বাতিলযোগ্য। বর্তমান ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধিমালা-২০০৯ এর বিধিবিধান অনুসারে গঠিত না হওয়ায় আইনগত বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ এপ্রিল, ২০১৯ রুলনিশি আদেশ বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় কমিটির এ ধরনের সিদ্ধান্ত বেআইনি, অকার্যকর ও আইন অমান্যের শামিল।
এ ব্যাপারে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহীর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহা: মোকবুল হোসেনকে ফোন দিলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিভাগের সচিব মো: মাহবুব হোসেনকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর ইমামকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো কমেন্টস নেই। আর কোথা থেকে নাম পরিবর্তনের কথা শুনেছেন? আমি সংসদ অধিবেশনে আছি, পরে ফোন দেন।’  

 


আরো সংবাদ



premium cement