২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঘর ছাড়ছে গারো সম্প্রদায়

-

জীবন ও জীবিকার জন্য অস্তিত্বের লড়াইয়ে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে মধুপুর গড়াঞ্চল ও সীমান্তবর্তী এলাকার গারো, হাজং সম্প্রদায়সহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বনাঞ্চল উজাড়ের সাথে সাথে তাদের জীবনজীবিকা, আয়রোজগার, সংস্কৃতি সবই তিগ্রস্ত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অরণ্যের জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সর্বত্রই দারিদ্র্য ভর করছে। একসময় অভাবের তাড়নায় বসতভিটা বিক্রি করে স্থানান্তরিত হলেও এখন কাজের সন্ধানে অরণ্য আর সীমান্তবর্তী ভিটা ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর হাজারো গারো নারী-পুরুষ।
হালুয়াঘাটের সীমান্তবর্তী সূর্যাপুর সুমিনয়পাড়ার আপেল সিমসাং (২৭) ময়মনসিংহ নগরীর একটি সেলুনে কাজ করেন। তার পৈতৃক নিবাস মধুপুর গড়াঞ্চলের গাছাবাড়ি এলাকায়। বৈবাহিক সূত্রে হালুয়াঘাটেই তার বসবাস। আলাপকালে আপেল জানান, একসময় তাদের দুই একর জমি ছিল। পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। অভাবের তাড়নায় জমিও বিক্রি করতে হয়। এখন তাদের বসতভিটা ছাড়া ২০ শতক কৃষি জমি আছে। প্রাইমারি স্কুলের পর তাদের আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। তার সম্বন্ধি (বউয়ের বড় ভাই) বলথং পাট্টা (৩০) এখন মালয়েশিয়া প্রবাসী। আরেক সম্বন্ধি সকাল পাট্টা (২৭) ময়মনসিংহের ভালুকার শিল্পাঞ্চলে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। তার শ্যালক দুর্জয় (২০) ঢাকার খিলক্ষেতে মুসলমান পরিবারের গাড়িচালক, আরেক শ্যালক কিল্টন (১৮) গুলশানে সেলুনে কাজ করেন। তার এক খালাতো শ্যালক হারকুলিস (২০) মিরপুরে রেস্টেুরেন্টে কাজ করেন। বাড়িতে শুধু তার স্ত্রী ও শাশুড়ি থাকেন। সবাই কর্মক্ষম হওয়ায় এখন তাদের পরিবারে কোনো অভাব নেই। বরং তাদের আয়রোজগারে জমি কেনার সামর্থ্য হয়েছে। কাজের সুবাদে তারা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাদের গ্রামের ঘরে ঘরে একই অবস্থা। কেউ-না-কেউ কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়েছেন।
ধোবাউড়া উপজেলার চন্দ্রকোনা গ্রামের লিটা মানকিনের স্বামী ঢাকার উত্তরায় এক মুসলিম পরিবারের গাড়িচালক। মেয়ে নিয়ে তিনি বাড়িতেই বসবাস করেন। এসএসসি পাস করলে মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সাথে রাজধানীমুখী হবেন। তিনি জানান, গ্রামের বেশির ভাগ গারো মেয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি দিনমজুরি করে। মৌসুম চলে গেলে বেকার থাকে। তাই একটু লেখাপড়া করে অনেকেই শহরে কাজের সন্ধানে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। ময়মনসিংহ নগরীর একটি সেলুনে কাজ করে জিহুদা ম্রং (২৮)। তিনি মধুপুরের গাছাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। গত বছর সে গারো সম্প্রদায়ের তিন শ’ নারী-পুরুষকে শহরে কাজ দিয়েছে। এ জন্য জনপ্রতি সে দুই-তিন হাজার টাকা পেয়েছে। তার মতো অনেকেই গ্রাম থেকে লোক সংগ্রহ করে শহরে কাজে পাঠায় বলেও জানায় সে।
ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার কতজন গারো নারী-পুরুষ কাজের সন্ধানে ঘর ছেড়ে নগরে পাড়ি জমিয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে প্রত্যেক ঘর থেকেই অপ্রাপ্তবয়স্ক ও প্রবীণ নারী-পরুষ ছাড়া সবাই এখন গ্রামছাড়া। তারা জীবিকার জন্য ছুটে চলেছেন শহর, বন্দর ও নগরে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধুপুর গড়াঞ্চল ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশে ৮৪ হাজার ৫৬৫ জন গারো ও ৯ হাজার ১৬২ জন হাজং, ১৬ হাজার ৯০৩ জন কোচ, ৫৩ হাজার ৭৯২ জন বর্মণসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। মধুপুর বনাঞ্চলের ৪৪টি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার ুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যের মধ্যে গারো ও কোচ ২০ হাজার। বেসরকারি সংস্থা ‘সেড’র তথ্য অনুযায়ী, এখানকার এক হাজার ১৮৯ জন তরুণী বিউটি পার্লারে কাজ করেন। আচিকমিচিক সোসাইটির পরিচালক সুলেখা ম্রংয়ের মতে, দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাবা-মায়ের মুখে অন্ন তুলে দিতে গারো মেয়েরা স্কুল ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়। মেয়েরা পার্লারে বিউটিশিয়ানের কাজ করেন। তুলির আঁচড়ে সৌন্দর্য ও লাবণ্যতা ফুটিয়ে তোলেন। পার্লার ব্যবসা লাভজনক হলেও বিউটিশিয়ানরা তেমন বেতনভাতা পান না। পান না বোনাসও। এমনকি চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। এটি এমন একটা পেশা, যেখানে অভিজ্ঞদের বেতনভাতা বাড়ানোর সময় এলে নির্বিচারে ছাঁটাই চলে।
ট্র্যাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অরণ্য চিরান জানান, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালে বিভিন্ন ঘটনায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের গড়াঞ্চল এবং সীমান্তবর্তী গারো ও হাজংসহ উপজাতিরা বিভিন্ন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। অভাব অনটনের কারণে অনেকে জমিজমা বিক্রি করেই ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছেন। অনেকেই এক কাঠা জমি বিক্রি করেছেন; কিন্তু জবরদখল হয়েছে অনেক বেশি। এ ধরনের ঘটনায় বহু মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে। অনেকেই বাঙালিদের বিয়ে করে বাড়িঘর ছেড়েছেন। অনেকেই আছেন, যাদের বংশপরম্পরায় এলাকায় বসবাস। কিন্তু তাদের জমির দলিলপত্র নেই। আর এতেই হয়েছে যত ঝামেলা। এদের উচ্ছেদ করে সুযোগসন্ধানীরা জবরদখল করেছে। উপজাতীয় অনেকের মতে, তাদের ভূ-সম্পত্তি বেহাত হওয়ার অন্যতম কারণ পপাতমূলক মাতৃতান্ত্রিক সম্পত্তিপ্রথা।
গবেষকদের তথ্যমতে, গারোদের আদি নিবাস চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিন কিয়াং প্রদেশে। সেখান থেকে তিব্বত অঞ্চল এবং পরবর্তী সময়ে ভারত উপমহাদেশে গারোরা বসতি স্থাপন করেন। ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বে জাপ্পা জালিমের নেতৃত্বে ভারত উপমহাদেশে গারোদের আগমন ঘটে। প্রথমে তারা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন। ‘গারো পাহাড়’ নামকরণ গারোদের নামানুসারেই হয়। বর্তমানে ভারতের মেঘালয় ছাড়াও আসাম, কামরূপ, কোচবিহার, নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকা ও গাজীপুর জেলায় গারোরা বসবাস করেন।
গারোদের সমাজে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারপ্রথা প্রচলিত। তাই মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে গারো নারীরা পরিবার ও সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। জাতিগত পরিচয়ের েেত্র অনেক গারোই নিজেদেরকে ‘মান্দি’ বলে পরিচয় দেন। গারোদের ভাষায় ‘মান্দি’ শব্দের অর্থ হলো ‘মানুষ’। তাদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের নাম ‘ওয়ানগালা’; যাতে দেবতা মিসি আর সালজংয়ের উদ্দেশে উৎপাদিত ফসল উৎসর্গ করা হয়। বলা হয়, ওয়ানগালা না হওয়া পর্যন্ত মান্দিরা নতুন উৎপাদিত ফসলাদি খান না।
গারোদের আদি ধর্মের নাম ‘সাংসারেক’। ১৮৬২ সালে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বর্তমানে ৯৮ ভাগ গারোই খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে গারোদের সামাজিক নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠানেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। তবে মাতৃতান্ত্রিক প্রথার পরিবর্তন হয়নি। গারো পরিবারে কন্যাসন্তান সব সম্পত্তির অধিকারী হন। আগে পরিবারের ছোট মেয়ে সব সম্পত্তির মালিক হতো। বর্তমানে অনেক মা-বাবাই তাদের সব সন্তানকে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে থাকেন। ছেলেদের বিয়ের পর স্ত্রীর বাড়িতে থাকতে এবং স্ত্রীর পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে হয়। গারো সমাজে যদিও মেয়েরা সম্পত্তির মালিক হয়ে থাকেন, পুরুষরা গৃহস্থালি ও সম্পত্তি দেখাশোনা ও সমাজের ভালোমন্দ পরিচালনা করেন।
বর্তমানে দেশে ৮৪ হাজার ৫৬৫ জন গারো রয়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, মুক্তাগাছা, ভালুকা, ফুলবাড়িয়া, ফুলপুর, জামালপুর ও শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী, নকলা, নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি, বকসীগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল, মধুপুর, নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দায় গারোদের বসবাস। ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুরে গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিবরণে নবম-দশম শতাব্দীতে বাংলাদেশের গারো পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমিতে গারোদের বসতি স্থাপনের কথা জানা যায়।


আরো সংবাদ



premium cement