১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সংসদে বিল উত্থাপন

৬১টি সংস্থার ব্যাংকে জমা অর্থ কোষাগারে দিতে হবে

-

৬১টি স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থার ব্যাংকে থাকা বিপুল উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমার বিধান করে গতকাল মঙ্গলবার সংসদে একটি বিল উত্থাপিত হয়েছে।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতেই এই উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি জানান, সংস্থাগুলোর বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল অর্থ জমা পড়ে আছে, যা জনগণের ব্যবহার করা সমীচীন। ‘স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০২০’ শীর্ষক বিলটি সম্পর্কে মন্ত্রী জানান, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের সংস্থান প্রয়োজন; যা বর্তমান সংগৃহীত রাজস্ব দ্বারা মেটানো দুরূহ হওয়ায় সংস্থাগুলোর তহবিলে রক্ষিত উদ্ধৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গৃহীত উন্নত দেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এটি আনা হয়েছে।
বিলের বিধান অনুযায়ী সংস্থার বার্ষিক পরিচালনা ব্যয়, নিজস্ব অর্থায়নে অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বার্ষিক ব্যয় নির্বাহের অর্থ, আপদকালীন ব্যয়ের জন্য বার্ষিক পরিচালনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থের অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত অর্থ প্রতি অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী বিলটি উত্থাপন করেন। পরে সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় বৈঠকে সভাপতিত্ব করছিলেন।
তবে বিলটি উত্থাপনের আগে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম আপত্তি জানান। কিন্তু কণ্ঠভোটে তা নাকচ হয়ে যায়। তিনি আপত্তি জানিয়ে বলেন, সরকার ঠিকমতো রাজস্ব আদায় করতে না পেরে এখন এসব সংস্থার ফান্ডে হাত দিতে এই বিল আনছে। যে সংস্থাগুলোকে তফসিলভুক্ত করা হয়েছে এগুলোর অন্তত ১০টি জয়েন স্টকে নিবন্ধিত। এগুলোর টাকা আপনি নিয়ে নিতে পারেন না। এর অনেকগুলোর শেয়ার মার্কেটে শেয়ার আছে। কেউ এগুলোর শেয়ার আর কিনবে না। আপনি এগুলোর লভ্যাংশ নিয়ে যাবেন-এতে পলিটিক্যালি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে পুঁজিবাজার একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিলটি সংসদীয় কমিটিতে যাবে। সেখানে এ জাতীয় আলোচনার সুযোগ আছে। আপনার প্রতিটি শব্দের জবাব আমার কাছে আছে। আমি সেখানে দেবো। তাতে আপনাকে খুশি করব। তিনি বিলটি উত্থাপনের জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে স্পিকার আপত্তিটি ভোটে দিলে কণ্ঠভোটে নাকচ হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী বিলটি উত্থাপন করেন।
বিলের তফসিলে ৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং এই তফসিল সংশোধনেরও সুযোগ রাখা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ জাতীয় কারিকুলাম এবং টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও দিনাজপুর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বগুড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক), জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ), বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ, রাজশাহী), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পেট্রেলিয়াম করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমানপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এবং বাংলাদেশ টেলি রেগুলেটরি কমিশন। বিলে ৯টি ধারা ও একটি তফসিল রয়েছে। তফসিলে সংস্থাগুলোর তালিকা উল্লেখ রয়েছে।
কোনো সংস্থা তহবিলে রক্ষিত অর্থ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান না করলে সরকার ওই সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে মর্মে বিলের ধারা-৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে। বিলের ধারা-৩ এ বলা হয়েছে তফসিলভুক্ত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমার ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানই প্রাধান্য পাবে। কোনো সংস্থা এই আইনের কোনো বিধানকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করলে তা অকার্যকর মর্মে গণ্য হবে।
বিলের ধারা-৪ এ পরিচালনা ব্যয়, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়, আপদকালীন ব্যয়ের জন্য বার্ষিক পরিচালনা ব্যয়ের ২৫ শতাংশ জমা রাখা এবং পেনশন ও ভবিষ্য তহবিলের অর্থ জমা রাখার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সংস্থাগুলোর বাজেট বরাদ্দ থেকে প্রদত্ত অনুদান সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রদান করা হবে মর্মেও উল্লেখ রয়েছে। ধারা-৫ এ উপরিউক্ত ধারা-৪ এ উল্লিখিত ব্যয়ের অতিরিক্ত সব ব্যয় প্রতি অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমার বাধ্যবাধকতার বিধানের কথা বলা হয়েছে। বিলের ধারা-৮ এ বলা হয়েছে, আইনের বিধানের অস্পষ্টতার কারণে তা কার্যকরে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে সরকার অন্যান্য বিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা উক্ত বিধানের স্পষ্টীকরণ বা ব্যাখ্যা প্রদান করে করণীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারবে।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত/আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ অন্যান্য স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী আয়-ব্যয় ও বছর সমাপনান্তে তাদের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। ব্যাংকে রক্ষিত হিসাবগুলোর স্থিতি হতে দেখা যায়, বর্ণিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল অর্থ জমা পড়ে আছে। সংস্থাগুলোর তহবিলে রক্ষিত উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকানা প্রকৃতপক্ষে জনগণের এবং সেই কারণে ওই অর্থ জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্যবহার করা সমীচীন। জনগণের আশা আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সরকার ব্যাপকভিক্তিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ওই পরিকল্পনা ও গৃহীতব্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়াবদ্ধভাবে বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জন। ওই প্রকল্পগুলে বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের সংস্থান প্রয়োজন, যা বর্তমান সংগৃহীত রাজস্ব দ্বারা মেটানো দুরূহ। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং সরকারি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকল্পে উল্লিখিত সংস্থাগুলোর তহবিলে রক্ষিত উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গৃহীত উন্নত দেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিলটি আনা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement