২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঢাকার নবাবগঞ্জে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ভাঙা মসজিদ

অনন্য স্থাপত্য
-

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিমি. দূরে নতুন বান্দুরা শাহী মসজিদ তথা ভাঙা মসজিদের অবস্থান। প্রায় ৫০ শতাংশ জমির উপর তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির অবস্থান থাকলেও মাত্র দুই শতাংশ জমির উপর রয়েছে মূল ভবনটি। মূল ভবনের সাথে নির্মাণ হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণের সবচেয়ে বড় মিনার। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মুসল্লি মসজিদটিতে আসেন এবাদত করতে ও তাদের মনের বাসনা জানাতে।
ভাঙা মসজিদটি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কল্পকাহিনী শোনা যায়। অনেকে বিশ্বাস করে ভাঙা মসজিদটি গায়েবি মসজিদ। এর মূল ভবনটি মাটির নিচ থেকে উঠেছে। তাদের মতে ভাঙা মসজিদে নামাজ পড়ে কোনো কিছু মানত করলে আল্লাহর রহমতে সেই আশা পূরণ হয়। সেই বিশ্বাসেই দিন দিন মসজিদে অতিথিদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত। সেই হিসাবে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো মসজিদটি নবাবগঞ্জের কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ১৬৫ ফিট সুউচ্চ একটি মিনার, যা ঢাকা দক্ষিণের সবচেয়ে বড় মিনার হবে বলে জানা যায়।
এলাকার মুরব্বিদের ধারণা, ১৬১০ সালে ভারত বর্ষের মুঘল বংশের দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খান চিশতি বিভিন্ন প্রয়োজনে দিল্লি থেকে নৌবিহার নিয়ে পদ্মা পাড় হয়ে ইছামতি নদী দিয়ে ঢাকা যাতায়াত করতেন। সেই সময় রাতযাপন ও ইবাদত করার জন্য আনুমানিক ১৬১৫ সালে নদীর পাশেই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তখন পুরো এলাকাই ছিল বনাঞ্চল। ১৮৮০তে হিন্দু জমিদাররা এসব বনাঞ্চল পত্তন নেন। তারা তাদের বসতি স্থাপন করার জন্য বনাঞ্চল কাটা আরম্ভ করেন। তখন দেখতে পান একটা মসজিদ ঘর, যার উপরের কিছু অংশ ভাঙা। তখন থেকেই এই মসজিদের নাম হয় ভাঙা মসজিদ বা গায়েবি মসজিদ। সেখানে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে সেগুলো হারিয়ে গেছে।
তখন মসজিদের দেখাশুনার জন্য দায়িত্ব নেন স্থানীয় আলফু ফকির, দুদু মীর, আবেদালী মীর, গোপাল মাদবর, মৈজদ্দিন সিকদার, গহের আলী খন্দকারসহ স্থানীয়রা। সেই সময় আবু মোল্লাকে মসজিদের মোতোয়াল্লি বা সেবায়েত নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৫ সালে স্থানীয় আবেদ আলী নিজ অর্থায়নে কিছু অংশ সংস্কার করেন। তখন মসজিদের সেবায়েত হিসেবে দুখাই বেপারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬০ সালে নতুন বান্দুরা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে আসেন আফজাল হোসেন নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি গ্রামবাসীকে নিয়ে মসজিদটির কিছু অংশ মেরামত করেন এবং মসজিদ পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। তখন ডা: আলমাছ উদ্দিনকে সভাপতি, মকবুল বেপারীকে সাধারণ সম্পাদক ও কদম আলীকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটি প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮০ সালে স্থানীয় আমজাদ হোসেন মাদবর গ্রামবাসীকে নিয়ে মসজিদের নতুন কমিটি ঘোষণা করে দায়িত্ব বুঝে নেন। দায়িত্ব নেয়ার পরই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। তখন মূল ভবনের সংস্কার করলেও তার অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। দীর্ঘ সময় মসজিদের সেবায়েত হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন মরহুম সামসুদ্দিন মুন্সি। পরবর্তী সময়ে আমজাদ হোসেন মাদবরের ছোট ছেলে কুয়েত প্রবাসী নজরুল ইসলামের প্রচেষ্টায় বিদেশের অর্থায়নে মসজিদটির সংলগ্ন আরেকটি ভবন তৈরি করা হয়। ২০০১ সালে মসজিদ কমিটি মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি মিনার নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করে মাটির নিচে প্রায় ৬০ ফুট বোরিং করে রডের খাঁচা বেঁধে ৬০ ফুট চালাইয়ের উপর ১৪টি পিলার নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ই তাদের ব্যয় হয়েছিল প্রায় সাত লাখ টাকা। কিছু দিন কাজ করার পর মিস্ত্রি ও আনুষঙ্গিক অসুবিধার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১১ সালের ৪ মার্চ পুনরায় মিনারের কাজ আরম্ভ হয়। ১৬৫ ফিট উচ্চতাবিশিষ্ট মিনারটির কাজ এখন সমাপ্তির পথে। এই পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানায় মসজিদ কমিটি। তবে মসজিদ সংস্কার ও প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মিনারটি নির্মাণে সরকারিভাবে কোনো সাহায্য নেয়া হয়নি। মসজিদে আগত অতিথিদের অনুদানেই মিনারটি নির্মিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে প্রায় ৩০ বছর ধরে মসজিদের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকারী মো: ফজলুর রহমান বলেন, মানুষ আল্লাহ ওপর বিশ্বাস করেই ভাঙা মসজিদে আসেন এবাদত করতে। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার কয়েক হাজার মানুষের আগমন ঘটে এই মসজিদে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি তাদের সহযোগিতা করতে।
মসজিদের ইমাম হিসেবে কর্মরত আছেন মুফতি মতিউর রহমান। তিনি নয়া দিগন্ত প্রতিনিধিকে জানান, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তিনি ওই পদে চাকরি করে আসছেন। তার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। তিনি জানালেন, প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী দূর-দূরান্ত থেকে মসজিদটি পরিদর্শন করতে আসেন। অনেকে আসেন মানত হিসেবে গরু, ছাগল, মুরগিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য নিয়ে। মসজিদ কমিটি উল্লিখিত মানতের মালামাল বিক্রি করে মসজিদের উন্নয়নকাজে ব্যবহার করে। নামাজ পরিচালনা ছাড়াও ইমাম সাহেব মসজিদভিত্তিক মক্তব পরিচালনা করে এলাকার শিশুদের নামাজসহ ইসলামের মূল বিষয়গুলো শিক্ষা দেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement