২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

৩ বছর ধরে তালাবদ্ধ ৫ কোটি টাকার যন্ত্র ১টি পর্দার দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা

ফমেকে দুর্নীতি ছাড়িয়ে গেছে রূপপুরের বালিশ কাণ্ড
-

ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ (ফমেক) হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দুর্নীতি যেন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বালিশ ক্রয়ের দুর্নীতিকেও হার মানিয়েছে। রূপপুরে ছয় হাজার টাকায় বালিশ কেনা হয়েছিল আর এখানে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে আইসোলেশন কক্ষের পর্দা! এ ছাড়া আরো অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে দুর্নীতির বিস্তর নজির। এমনই একটি আমেরিকার তৈরি ভিএসএ অনসাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্লান্ট, যাতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন এসব যন্ত্রপাতির খোঁজ নেয় কর্তৃপক্ষ। এ সময় একটি অক্সিজেন জেনারেটিং প্লান্টের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, যন্ত্রটি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের পেছনে পশ্চিম পাশের একটি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে। গত তিন বছর ধরে ওই কক্ষ তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। গতকাল ওই প্লান্টটি দেখানোর সময় তালায় জং ধরে যাওয়ায় হ্যাক্সো ব্লেড দিয়ে তালার কড়া কেটে ওই কক্ষে ঢুকতে হয়েছে। তবে যন্ত্রটি সচল রয়েছে কি না তা জানা যায়নি। এ ছাড়া এ সময় কয়েকটি যন্ত্র খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনায় অনিয়ম এবং আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে অভিমত ব্যক্ত করে হাইকোর্ট দুদককে এ বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ওই সময়কালে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ৫১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিভিন্ন ধরনের ১৬৬টি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। অনিক ট্রেডার্স ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিল পেলেও ১০ কোটি টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানোসহ বিভিন্ন অসঙ্গিতির কারণে আটকে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ১ জুন অনিক ট্রেডার্স হাইকোর্টে একটি রিট করে। এ রিট করার পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্ব্যসেবা বিভাগের সচিব ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অনিক ট্রেডার্সের সরবরাহ করা ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির একটি তালিকা চেয়ে পাঠান।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই ১০ কোটি টাকার বিপরীতে দামসহ ১০টি আইটেমের যন্ত্রপাতির একটি তালিকা দেন।
ওই তালিকার সাথে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সরেজমিন পরিদর্শকালে দেখা যায়, পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আমেরিকার তৈরি ভিএসএ অনসাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্লান্ট গত তিন বছর ধরে তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচে হাসপাতাল সার্টেইন সিস্টেটেম ফর আইসিইউ/সিসিইউ বেডস কোরিয়া খাতে ১৬টি শয্যার জন্য সাড়ে ১২ হাত দৈর্ঘ্য ও সাড়ে চার হাত প্রস্থবিশিষ্ট আধুনিক পর্দা কেনা হয়েছে। ১৬টি শয্যার জন্য কেনা এই পর্দার প্রতিটি ক্রয়ে খরচ দেখানো হয়েছে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৫ টাকা করে। তবে যন্ত্রপাতি থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় গত তিন বছর ধরে এই সিসিইউ ইউনিটটিতে কোনো কার্যক্রম নেই। ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র স্টাফ নার্স রাজিয়া সুলতানা জানান, তিনি প্রতিদিন এ কক্ষ খোলেন এবং দেখাশুনা করেন আবার বন্ধ করে দেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনটি ডিজিটাল প্রসেসর সিস্টেম, যা আমেরিকার তৈরি তার দাম দেখানো হযেছে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল প্রসেসর সিস্টেম যে মেশিনটি সরবরাহ করা হয়েছে সেটি আমেরিকার তৈরি নয় বরং কোরিয়ার তৈরি যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এ ছাড়া আমেরিকার তৈরি ভ্যাকুয়াম প্লøান্টের দাম দেখানো হয়েছে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা; কিন্তু এটি পুরনো দন্ত বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে। এই কক্ষও খোলা হয় না এবং এই যন্ত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে না।
২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচে আমেরিকার তৈরি বিআইএস মনিটরিং সিস্টেম মেশিনটি অপারেশন থিয়েটারে স্থাপন করা হয়েছে বলে বলা হলেও বাস্তবে এটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে স্টোরকিপার আব্দুর রাজ্জাক দাবি করেছেন, ‘এই মেশিনটি আছে হয়তো অন্য কোনো নামে, কোথাও পড়ে আছে।’
স্মরণকালের এই দুর্নীতিকাণ্ডে চারটি থ্রি হেড কার্ডিয়াক স্টেথিসস্কোপ আমেরিকার তৈরি দাম দেখানো হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার পাঁচ শ’ টাকা। এর দু’টি সিসি ওয়ার্ড ও দু’টি মেইল মেডিসিন ওয়ার্ডের দুই ইউনিটে রয়েছে।
২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচে আমেরিকার তৈরি দু’টি ফাইবার অপটিক ল্যারিনগোসস্কোপ সেটের একটি গাইনি ওটিতে এবং একটি জেনারেল ওটিতে স্থাপন করা রয়েছে। ওই সময়ে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচে কেনা কোরিয়ার তৈরি ছয়টি টোমেটিক স্কাব সিস্টেম অপারেশন থিয়েটারে এবং তিন লাখ টাকায় কেনা ১০টি চায়নিজ সার্কশন মেশিন অপারেশন থিয়েটারের জন্য কেনা হয়।
চার লাখ ৮৭ হাজার পাঁচ শ’ টাকা খরচে আমেরিকার তৈরি ২০টি ড্র সিস্টেম ইকুইপমেন্ট আইসিইউ ওয়ার্ডে স্থাপন করা হয়েছে। ওয়ার্ডটি চালু না থাকায় কোনো কাজে লাগছে না এসব।
২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ উন্নয়ন ও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পের অধীনে এ যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এ সময় ফমেক হাসপাতালের পরিচালক পদে ছিলেন আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী, এ বি এম শামসুল আলম, মো: ওমর ফারুক খান, গণপতি বিশ্বাস শুভ ও আবুল কালাম আজাদ। এর মধ্যে ওমর ফারুক খান মারা গেছেন।
সাবেক পরিচালক গণপতি বিশ্বাস বলেন, তিনি প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, আদালতে কোনো বিষয়ে মামলা হয়েছে কিংবা আদালত কী নির্দেশনা দিয়েছেন তা তার জানা নেই।
আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, আমি প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলাম। যে কেনাকাটার কথা বলা হচ্ছে তা প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিল না। যা প্রকল্পের বিষয়ই ছিল না তার দায়ভার প্রকল্পের ওপর কেন বর্তাবে তা আমার বোধগম্য নয়।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, আদালতের নির্দেশনা তিনি পাননি। পেলে তিনি আদালতের নির্দেশনা মেনে চলবেন। দুদক যদি তদন্ত করে তবে তাকে তিনি সহযোগিতা করবেন। তিনি বলেন, ১০ কোটি টাকায় যেসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে তার মূল্য কিছুটা অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে বলে তার ধারণা। তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।


আরো সংবাদ



premium cement