২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নওগাঁর বলিহার রাজবাড়ির হালচাল

অনন্য স্থাপত্য
-

ঐতিহ্য ঘেরা উত্তরবঙ্গের ভারত সীমান্তঘেঁষা বরেন্দ্র অঞ্চল নামে অবহিত নওগাঁ জেলা। এ জেলায় রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর বিহার)। শুধু পাহাড়পুরই নয়, রয়েছে আরো অনেক ঐতিহ্যে ভরা ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা। তারই একটি অংশ বলিহার রাজবাড়ি। এ রাজবাড়িতে এখন নেই সেই রাজা আর সেই রাজার রাজ্যও। কিন্তু এখনো কথা বলে এই রাজ্যের রাজা ও জমিদারের সময়ের রোপণ করা অনেক বটবৃক্ষ আর বিভিন্ন স্থাপনা। শুধু কালের সাী হয়ে রাজার শাসন আমলের স্মৃতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী বলিহার রাজবাড়িটি।
এখনো রাজবাড়িতে আছে দেবালয়। সেখানে হয় না আর নিয়মিত পূজা-অর্চনা। দেবালয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে দেবদাসীদের নৃত্যাঞ্জলি, শঙ্খ ধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, ধূপের ধোঁয়া আর খোল-করতালের শব্দ থেমে গেছে বহু আগে। দেবালয়ের দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ঠ আর দেয়াল পেরিয়ে দেবদাসীদের হাসি-কান্নার শব্দ হয়তো এখনো ভেসে বেড়ায় বলিহারের ভগ্ন রাজপ্রাসাদের আকাশে-বাতাসে। তাই আসুন না একবার ঘুরে আসি এই ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি আর দেখে আসি শত শত বছর আগের স্থাপনাগুলো। পরিচিত হই আপন দেশের ইতিহাসের সেই কালের সাক্ষীগুলোর সাথে।
নওগাঁ জেলা সদরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম সকাল ৯টায়। চার দিকে বাসের স্টাফদের যাত্রী ডাকার চিৎকার আর চেঁচামেচি সকালের পরিবেশটা অস্থির করে তুলছিল। আমরা মান্দাগামী একটি বাসে চাপলাম। ১০-১২ মিনিট পর বাসটি বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করল। আমরা বাস থেকে নামব নওগাঁ-রাজশাহী সড়কের বাবলাতলির মোড়ে। ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের রাস্তায় ৩৫ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম বাবলাতলি মোড়ে। সেখানে ছোট্ট চায়ের দোকানে রঙ চা খেলাম। গরমের দিন গরম চায়ে একটু উষ্ণ পরশ নিলাম। সামনে বলিহার কলেজ ভবন। পাশ দিয়ে সরু এবড়োখেবড়ো পাকা রাস্তা চলে গেছে বলিহার রাজবাড়িতে। তা সব মিলিয়ে আধা মাইল। হেঁটে রওনা হলাম আমরা। রাস্তার দুই ধারে আকাশমণি গাছে গাছে অপরূপ লাগছে। সামনে বিশাল দু’টি দীঘি পড়তেই বুঝতে পারলাম আমরা প্রাসাদের কাছাকাছি চলে এসেছি। প্রাচীন বড় বড় কয়েকটি তেঁতুলগাছ আর বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদে প্রবেশের আগেই। রাজবাড়ির সামনেই বলিহার বাজার।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সনদ বলে নওগাঁর বলিহারের এক জমিদার জায়গির লাভ করেন। জমিদারদের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ সালে বলিহারে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মন্দিরে রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মূর্তি স্থাপন করেন। বলিহারের ৯ চাকার রথ এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরেই ছিল বিশাল বাগান। বাগানে এখনো কিছু রাজার শাসনামলে রোপণ করা গাছ রয়েছে। তবে বাগানবাড়িটির সামনের পুকুর ঘাটের একটি ছাদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বসত নিয়মিত জলসা। কলকাতা থেকে আনা হতো নামকরা নর্তকীর দল। বলিহারের রাজাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিতি ছিলেন। রাজা কৃষ্ণেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলী প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড অন্যতম।
দেশ বিভাগের সময় এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে অন্য সব রাজার মতো বলিহারের রাজার উত্তরাধিকারী বিমেলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর প্রাসাদ ভবনটি রাজ পরিবারের অন্যান্য কর্মচারী দেখভাল করতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও পরে লুট হয়ে যায় রাজবাড়ির বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মহামূল্যবান নিদর্শন, আসবাবপত্র, জানালা-দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী। দর্শনীয় প্রাসাদটির কয়েকটি ভবন বর্তমানে কোনো মতে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে একসময়ের বলিহার রাজাদের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে।
কথিত আছে বলিহারের জমিদারিতে ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর ছিল। এখনো অনেক দীঘি ও পুকুর রয়েছে। এসব দীঘি ও পুকুরের নাম খুবই শ্রুতিমধুর যেমন মালাহার, সীতাহার, বলিহার, অন্তাহার। বিভিন্ন নামেই ছিল দীঘি ও পুকুরগুলোর পরিচিতি। শৌখিন রাজাদের ছিল মিনি চিড়িয়াখানা। সেখানে ছিল বাঘ, ভাল্লুক, বানর, হরিণসহ নানান প্রজাতির পশু ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
জনশ্রুতি আছে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিং বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে এ দেশে আসেন। তিনি তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে একপর্যায়ে বলিহার পৌঁছেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করায় সৈন্যরা কান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্রামের জন্য ও মানসিংয়ের প্রেরিত গুপ্তচরের মাধ্যমে বারো ভূঁইয়াদের খবর জানার জন্য যাত্রা বিরতি করেন সেনাপতি মানসিং। ওই সময় চলছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে শুষ্ক মওসুম। বেশি দিন বসে থাকলে সৈন্যরা অলস হয়ে যেতে পারে ভেবে মানসিং সৈন্যবাহিনী দিয়ে ওই ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর খনন করেন; যা এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা বলিহার এলাকাজুড়ে।
নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে ঐতিহাসিক বলিহার রাজবাড়িটি অবস্থিত। রাজবাড়ির একটি ভবন স্থানীয় একটি স্কুলের পাঠদান কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। নতুন স্কুল ভবন নির্মিত হওয়ায় রাজবাড়ির ভবনটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজ ভবনটি তিনতলা। ভবনের ছাদ থেকে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি মেলানো যায়। প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত বিশাল দেবালয়টিতে স্থানীয় হিন্দুরা পূজা-অর্চনা করেন। দেবালয়ের ভেতরে অনেক ক আছে। ভবনটি একসময় দোতলা ছিল।
ভবনের ওপরে ওঠার জন্য দু’টি সিঁড়ি আছে। প্রাসাদের সিংহ দুয়ার এখনো অনেকটাই শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের পেছনের মালিপাড়ায় বিশাল আকারের পাশাপাশি দু’টি শিব লিঙ্গ আছে। সেখানে পূজা হয়। প্রাসাদের ভবনগুলো ছিল একটি থেকে অন্যটি কিছুটা দূরে। প্রাসাদ চত্বরের মধ্যে ছিল আটচালা। বিভিন্ন পার্বণের দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত হতো নাটক, যাত্রা, কবিগান, কীর্তনসহ আরো কত কী! আটচালার নিকটতম ভবনের সিঁড়িগুলো ব্যবহৃত হতো গ্যালারি হিসেবে। মূল প্রাসাদের সামনে সতেজ দু’টি গাছ আছে। নাম নাগলিঙ্গম। বর্ষা মওসুমে গাছটিতে ফুল আসে।
অনেক আগে নওগাঁ মহাদেবপুর সড়কে বলিহার মোড় থেকে একটি পাকা সড়ক দিয়েই চলাচল করা হতো। সড়কটির দুই ধারে ছিল বিশাল বিশাল আমগাছ। প্রতিটি গাছের আমই ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। এখনো অনেক আমগাছ আছে রাস্তার দুই ধারে। বলিহারে শৌখিন জমিদারেরা সড়কটি নির্মাণ করেছিলেন। তখন ওই সড়ক দিয়েই রাজশাহীর সাথে নওগাঁর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওই সড়কই নওগাঁ-রাজশাহীর একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। পরে নওগাঁ-রাজশাহী অভ্যন্তরীণ মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে বলিহার সড়কটি রণাবেণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তবে এখনো সড়কটির কিছু কিছু স্থান অবশিষ্ট আছে। প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম একটি প্রাচীন রাজার বিলীন হয়ে যাওয়া রাজাশূন্য পড়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি। ফেরার পথে বারবার মনে হতে লাগল রাজা ও জমিদারি শাসন আমলে কেমন ছিল এই রাজ্যের সেসব দিন।
তবে এলাকার দুর্বৃত্ত আর দখলদারদের অবৈধ দখল আর অত্যাচারে রাজবাড়িটি তার অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। তবে এখনো যদি এ রাজবাড়িটির অবশিষ্ট অংশটুকু সরকারিভাবে পদক্ষেপ নিয়ে সংস্কার আর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তবে ভবিষ্যতে এই রাজবাড়িটি একটি ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। সরকার এখান থেকে প্রতি বছর রাজস্ব হিসেবে অনেক অর্থ আয় করতে পারবে। তাই সরকারের কাছে এলাকাবাসীদের দাবি যেন অচিরেই এই রাজবাড়িটির যেটুকু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে তা অবৈধ দখল মুক্ত করে তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করে আধুনিক মানের এক দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement
অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি

সকল