২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
জলবায়ু পরিবর্তন

সুন্দরবন উপকূলীয় জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তন : সুন্দরবন উপকূলের জীবন-জীবিকায় পড়েছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব - ছবি : নয়া দিগন্ত

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় পাইকগাছা-কয়রা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। নিয়ম করে বছরের বিভিন্ন সময় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে নদ-নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

এসব কারণে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে গাছ-পালা, নষ্ট হচ্ছে ফসলী জমি, হ্রাস পাচ্ছে কৃষি উৎপাদন। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একদিকে যেমন কর্মহীন হয়ে পড়ছে অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন এলাকা অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বসবাসের।
জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিবছর পেশাবদল করছে বহু মানুষ। অনেকে আবার নতুন কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এককথায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সামনে জীবিকার তাগিদে রীতিমত সংগ্রাম করতে হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের।

বৈষ্ণিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে আশংকাজনক হারে বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর কোনো না কোনো দুর্যোগ আঘাত হানছে এ অঞ্চলে। সিডর, আইলার ক্ষত কাটিয়ে উঠার আগেই গত ২ বছরে ৩টি বড় ধরনের দুর্যোগ আঘাত হেনেছে এলাকায়। এতে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।

সময়ের ব্যবধানে নাব্যতা হারিয়েছে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নদী। যার মধ্যে কপোতাক্ষ, শিবসা ও হাড়িয়া নদী অন্যতম। পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতার মুখে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় দু’উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। আর এ সুযোগে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে লবণ পানি। এসব নদ-নদীর মাধ্যমে সমুদ্রের উগড়ে দেয়া পানি ও অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষাবাদের ফলে বিভিন্ন পোল্ডার অভ্যন্তরে এক ধরনের অবাধে অনুপ্রবেশ ঘটছে লবণাক্ত পানির। এতে ফসলী জমির উর্বরতাশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীব ও প্রাণবৈচিত্র্য।

উপজেলার লতা ইউনিয়নের গঙ্গারকোনা গ্রামের অধিবাসী আদিত্য সরকার জানান, এলাকায় সুপেয় পানির তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিন পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এতে শ্রমের পাশাপাশি সময় অপচয় হয়।

এছাড়া লবণ পানির বিরূপ প্রভাব, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের উপচে পড়া পানিতে বনাঞ্চল উজাড়ের পাশাপাশি ঘর-বাড়িসহ কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে ও হচ্ছে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের।

লবণ পানির আধিক্যে ইতোমধ্যে অত্রাঞ্চল থেকে হারিয়ে গিয়েছে অসংখ্য দেশীয় প্রজাতির মাছ। বিভিন্ন সময়ের দুর্যোগের মুখে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় দূষণে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই।

ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে ইতোমধ্যে সরকার মেগা প্রকল্প হাতে নিলেও ঠিক কবে নাগাদ এর বাস্তবায়ন হবে তা নিয়েও রয়েছে আশংকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে তৃণমূলের সচেতনতাবৃদ্ধিতে ২০১৮ সাল থেকে দু’ উপজেলায় স্টেক হোল্ডারদের মাধ্যমে ‘পানিই জীবন’ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপ।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ক্ষয়ক্ষতি রোধ, সহায়তা প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে জিও-এনজিও পর্যায়ে কাজের পাশাপাশি প্রয়োজন পরস্পরের সমন্বয় সাধন। এজন্য সংশ্লিষ্টদেরকে নিয়ে দরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার।

এ প্রসঙ্গে উপজেলার দেলুটি ইউপি চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, তাদের ইউনিয়নটি একটি দ্বীপবেষ্টিত অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিনিয়ত সেখানে বাড়ছে নানা সংকট। বিশেষ করে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি সেখানকার বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাই অনেকেই প্রতিবছর অন্যত্র চলে যাচ্ছে মূলত বাধ্য হয়ে। এজন্য জিও-এনজিও পর্যায়ে দরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার।

তিনি বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির উৎস তৈরি ও এর প্লাটফর্মসহ টয়লেটের প্লাটফর্ম উঁচু ও উন্নত করা, স্থানীয় সরকার ও সরকারের জলবায়ু মোকাবেলায় অর্থায়ন বাড়ানো, পর্যাপ্ত ড্রেন, কালভার্ট ও সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণসহ কৃষিক্ষেত্রে লবণসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের অনেকগুলো জাত উদ্ভাবন দরকার। এজন্য তিনি উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠনেরও পরামর্শ দেন।

এদিকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-মান সমুন্নত রাখতে জিও-এনজিও পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষ।


আরো সংবাদ



premium cement