২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দৃষ্টিহীনদের বিনামূল্যে কম্পিউটার শেখাচ্ছেন ঢাবির দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহীন

দৃষ্টিহীনদের বিনামূল্যে কম্পিউটার শেখাচ্ছেন ঢাবির দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহীন - ছবি : নয়া দিগন্ত

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহীন আলম। বিনামূল্যে তিনি দৃষ্টিহীনদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন অনলাইনে।

২০২০ সালের জুলাই মাসে তিনি দৃষ্টিহীনদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দেন। তাতে দেশ-বিদেশ থেকে বেশ সাড়া পড়ে। তার ডাকে সাড়া দেন বাংলাদেশ ও ভারতের ৬০ জন দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে শুধু ভারতেরই ছিল ২০ জন দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী।

শুরু হয় অনলাইন ক্লাসের মধ্যমে প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ। সপ্তাহে ৩ দিন রবি, বুধ ও শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে দেড়ঘণ্টা ক্লাস নেন শাহীন আলম।

এরপর চলতি বছরের গোড়াতে শুরু হয় তার দ্বিতীয় ব্যাচ। এ ব্যাচেও বাংলাদেশ-ভারতের মোট ৫৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এখানেও ছিল ২০ জন ভারতীয় দৃষ্টিহীন নাগরিক।

জুলাইয়ে শুরু হয় তিন মাস মেয়াদি তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণ। এ ব্যাচে বাংলাদেশ-ভারত থেকে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৫ জন। ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে তৃতীয় ব্যাচের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। এখন চলছে চতুর্থ ব্যাচ শুরুর প্রস্তুতি।

শাহীন আলম ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার আলমপুর গ্রামের কৃষি শ্রমিক আব্দুল কাদেরের ছেলে। মা মিনারা বেগম গৃহিনী। শহীন আলমরা দু’ভাই। বড় ভাই ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন শাহীন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ় মনোবলের কাছে হার মানে তার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা।

২০১৩ সালে সমাজসেবা অধিদফতরের আওতাধীন সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের সহায়তায় তুলারামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নড়াইল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। পরে ২০১৫ সালে নিজ এলাকার শামসুল হুদা খান কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।

কলেজে ভর্তির সময় তার শিক্ষাজীবনে আসে বেশ কিছু বাধা। কলেজের শিক্ষকরা তাকে ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে নিজের পড়াশুনার দায়ভার নিজে নিলে কলেজে ভর্তির সুযোগ মিলে। এইচএসসি পাশের পর তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতির জন্য কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে পারেননি। অন্য বন্ধুদের শিট সংগ্রহ করে মোবাইলে রেকর্ড করে ভর্তির প্রস্তুতি চালিয়ে গেছেন।

অবশেষে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তার স্বপ্ন পূরণ হয়। সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার। ২০১৯ সালে তার অনার্স সমাপ্ত হয়। বর্তমানে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষার্থী।

নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন শাহীন বেসরকারিভাবে ১২ দিনের একটি কোর্সের মাধ্যমে কম্পিউটার শেখা শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিন মাস মেয়াদি আরো একটি কোর্স করেন।

তার অনলাইন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সে যা শেখানো হয় তা হলো - ফান্ডামেল্টালস অব কম্পিউটার, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, মাইক্রোসফট এক্সেল, মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট, ইন্টারনেট ব্রাউজিং ইত্যাদি। স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার ব্যবহার তিনি কম্পিউটার পরিচালনা করেন। শিক্ষার্থীরাও এই মাধ্যম ব্যবহার করে কম্পিউটার শিখেন।

নন ভিজুয়াল ডেক্সটপ এক্সেস (NVDA) ও জাভ এক্সেস উইথস্পিচ - এই দুই স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রদর্শিত হওয়া সকল তথ্যাদি সম্পর্কে অডিও ভয়েসের মাধ্যমে দৃষ্টিহীনদের নির্দেশনা প্রদান করে।

শাহীন আলম জানান, বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা করে সরকারি কোনো কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। যার ফলে তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান থেকে পিছিয়ে পড়ছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। তারা যাতে কোনোভাবেই তথ্য-প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যেই তার এই মহৎ উদ্যোগ।

তিনি জানান, প্রতিমাসে তার ইন্টারনেট বিল পরিশোধ করা কষ্টকর হচ্ছে। তার নিজস্ব লাইসেন্সকৃত জুম সফটওয়্যার হলে তার এই প্রশিক্ষণ পরিচালনা সহজতর হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন তার স্কলারশিপের জমাকৃত অর্থ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে, খরচ বেড়েছে। তার পক্ষে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যাপক কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ বেড়ে চলছে।

শাহীন আরো বলেন, প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা হলে দৃষ্টিহীনরা আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্সিং শিখে ঘরে বসেই অর্থ উপার্জন করতে পারবে।

কম্পিউটার হার্ডওয়্যার সম্পর্কেও বেশ পারদর্শিতা রয়েছে শাহীন আলমের। এর আগে শাহীন আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রিসোর্স সেন্টারে খণ্ডকালীন কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের একটি প্রকল্পে কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ফাল্গুনী পাল জানান, ‘আমি শাহীন স্যারের কাছে কম্পিউটার শিখে এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহার করে চাকরি করছি।’

বাংলাদেশের শেরপুর জেলার অপু আহমেদ ঢাকার সরকারি বাংলা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত, এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এত সুন্দরভাবে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিতে পেরে তিনি উপকৃত।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো: সরওয়ার হোসেন খান বলেন, ‘শাহীন আমাদের রিসোর্স সেন্টারে এসে নিজের পড়াশুনার প্রয়োজনে কম্পিউটার ব্যবহার করতো। তার কম্পিউটারের দক্ষতা বুঝতে পেরে আমরা তাকে ২০১৯ সালে খণ্ডকালীন কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করি। সে ১ বছরে ছয় মাস মেয়াদি দুটি ব্যাচে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার শিখিয়েছে। সে অনেক মেধাবী, কম্পিউটারে ভালো পারদর্শী। ভবিষ্যতে সে আরো ভালো কিছু করতে পারবে।’


আরো সংবাদ



premium cement