২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশের চিংড়িশিল্পে প্রাণ ফেরাবে ভেনামি

ভেনামি - ছবি : সংগৃহীত

দেশের বিপর্যস্ত চিংড়িশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে শেষমেশ ভেনামি চাষ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। খুলনার পাইকগাছায় প্রথম পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষও করা হয়েছে। চিংড়িশিল্পসংশ্লিষ্টরা আশা করছেন পরীক্ষামূলক চাষ সফল হবে। এরপর প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে ব্যাপক ভিত্তিতে চাষ শুরু হবে এবং দেশের চিংড়িশিল্প পুনর্জীবন পাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রানুযায়ী, দেশীয় বাগদা ও গলদা চিংড়ির উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ চিংড়ি রফতানিতে সুবিধা করতে পারছে না। ভেনামি চাষকারী চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দখলে চলে যাচ্ছিল চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজার। এ প্রেক্ষাপটে ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ১২ বছর ধরে সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চ ফলনশীল ভেনামি জাতের চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়া হয় কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস এবং সাতক্ষীরার এনজিও সুশীলনকে।

অ্যাগ্রি বিজনেস ব্যর্থ হয়েছে। আর সুশীলন একা না পেরে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাথে নেয় যশোর বিসিক শিল্পনগরীর এম ইউ সি ফুডসকে। মার্চ মাসের ৩১ তারিখ থাইল্যান্ড থেকে বিমানে করে আট লাখ ভেনামি চিংড়ির পোনা এনে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনস্থ খুলনার পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রের চারটি পুকুরে ছাড়া হয়। পুকুরে পোনা অবমুক্তির পর থেকে নিয়মিত পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন চিংড়ি বিশেষজ্ঞ ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক প্রফুল্ল সরকার। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে চিংড়ির গ্রোথ এবং রোগবালাই অনুসন্ধানে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। চলতি বছর এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি থাকায় কিছুটা শঙ্কা ছিল। তবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়েছে, ভেনামির রোগ প্রতিরোধ এবং জীবন ধারণ ক্ষমতা বাগদার তুলনায় বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে পোনা ছাড়ার পর সাত সপ্তাহ পর্যন্ত চিংড়িতে রোগবালাইয়ে আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ বিপজ্জনক সময় অতিক্রমের পর গত ৬ জুন পুকুরের পরিবেশ, ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগবালাই প্রতিরোধব্যবস্থা পরিদর্শন এবং চিংড়ির ফিজিক্যাল গ্রোথ পরিমাপে নমুনা পরীক্ষা করে একটি বিষেশজ্ঞ টিম। পরিদর্শন টিমে ছিলেন- খুলনা ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর মজিনুর রহমান, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীর, পরিচালক এম এ হাসান পান্না, বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ রফিকুজ্জামান, এম ইউ সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাসসহ ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা।

পরিদর্শনকালে ডিডি মজিনুর রহমান বলেন, ভেনামির পোনা ছাড়ার পরের ৬৮ দিনে গ্রোথ ও ফার্টিলিটি রেট খুবই আশাব্যঞ্জক। প্রতিটির ওজন ৮ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়েছে। গড় ওজন পাওয়া গেছে ৮.৭৫ গ্রাম। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদনকাল ১২০ দিন। প্রথম ৬০ দিনে এদের যে গ্রোথ হয়, পরবর্তী ৬০ দিনে তার তিন গুণেরও বেশি হয়। সে হিসাবে আশা করা যায় চিংড়ি ধরবার সময় প্রতিটির গড় ওজন ২৫ গ্রাম পাওয়া যাবে। বিশ্ববাজারে গলদা ও বাগদার দরপতনের কারণে চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। ফলে চিংড়ি চাষ কমে যাওয়ায় কর্ম সংস্থান কমছে এবং প্রতি বছর এ খাতের রফতানি আয় হ্রাস পাচ্ছে।

ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীর বলেন, কাঁচামাল চিংড়ির অভাবে মাছ কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত চিংড়িতে যে কয়টি কোম্পানি চালু আছে সেগুলোর সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১৮-২০ শতাংশ চাহিদা মিটছে। ফলে প্রক্রিয়াজাত করার খরচ বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের বাগদা চিংড়ির উৎপাদন পাওয়া যায় প্রতি হেক্টরে ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি। পক্ষান্তরে সেই একই পরিমাণ জমিতে ভেনামির উৎপাদন সাত থেকে আট হাজার কেজি হওয়া সম্ভব। গলদা ও বাগদা বছরে একবার চাষ হয়; কিন্তু ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার।
ফ্রোজেন ফুডস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক এবং বাংলাদেশে নিবিড়-আধা নিবিড় বাগদা চিংড়ি চাষের প্রবর্তক এম এ হাসান পান্না বলেন, ভেনামি চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে করতে হলে দেশেই ভেনামির এসপিএফ পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ভেনামি চাষ বিস্তার লাভ করতে পারবে না। আমরা দেশবাংলা হ্যাচারিতে সিপি থাইল্যান্ডের সহায়তায় ভেনামি পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছি।

ফাও এবং গ্লোবাল অ্যাকুয়াকালচার অ্যালায়েন্সের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী মোট ৪৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ভেনামি ছিল প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ। ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের হার ক্রমাগত সবখানে বাড়ছে, আর এর বিপরীতে ছিল বাংলাদেশের অবস্থান।

এ বিষয়ে দেশের প্রথম ভেনামি চিংড়ি চাষের উদ্যোক্তা এম ইউ সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, ৩৩ বিলিয়ন ডলারের চিংড়ির বিশ্ববাজার রয়েছে, যার ৮০ ভাগই দখল করে নিয়েছে অন্যরা। ফলে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে ভেনামি চাষের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রের পাইলটিং প্রজেক্টের চারটি পুকুরে আগামী ১৫-২০ জুলাই চিংড়ি ধরা হবে। এম ইউ সি ফুড গত ১ জুন ভেনামি রফতানি শুরু করার অনুমতি চেয়ে এফআইকিউসি খুলনার ডেপুটি ডিরেক্টর বরাবর আবেদন করেছে। সে আবেদনে তারা ১৫ থেকে ২০ টন চিংড়ি পাবে বলে জানিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আশা করা হচ্ছে, ভেনামি চাষ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ই বাড়াবে না, কর্ম সংস্থানের ক্ষেত্রও বাড়াবে এবং ধুঁকতে থাকা চিংড়িশিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাবে।


আরো সংবাদ



premium cement