১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডুবুরীদের বৃত্তের বাইরে আসার প্রতীক্ষা আর কত দীর্ঘ হবে?

পানিতে হারানো সোনা রূপার অলঙ্কার খুঁজতে পথে পথে হাঁটছেন ডুবুরী ইকরাম - ছবি : নয়া দিগন্ত

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সংকল্প কবিতায় লিখেছেন, ‘কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে।’ ডুবুরীদের নিয়ে কবি মনের এ আকুলতা, ব্যাকুলতা আমাদের এ পেশা সম্পর্কে ভাবায়। সিন্ধু সেঁচে মুক্তা না আনলেও আমাদের সুজলা সুফলা বাংলাদেশে এখনো এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা নদী-খাল-বিলের পানিতে হারিয়ে যাওয়া সোনা-রূপার অলঙ্কারাদী খুঁজে বের করাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ডুবুরী ইকরাম মিয়া (৪০) তাদেরই একজন।

চলমান দুঃসময়ে কেমন আছেন তিনি?

ইকরাম মিয়ার জবাব, ‘পিতা লাল মিয়ার পৈত্রিক নিবাস ঢাকার সাভার এলাকায় হলেও এখন আমরা পাবনার চাটমোহরের মথুরাপুর ইউনিয়নের তেনাচিরা (খড়বাড়িয়া) এলাকায় বসবাস করছি। প্রায় পনেরো বছর যাবত এ পেশায় আছি। জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয় আমাকে। যানবাহনে চলাচল করলে এর চেয়েও বেশি পথ অতিক্রম করি। সকাল ৮টার দিকে বাসা থেকে বের হই, ফিরতে ৩টা-৪টা বেজে যায়। কাঁধে বাঁশের সাথে সংযুক্ত লোহার আাঁকড়ে এবং টিনের খাঁচি দেখেই লোকে আমাদের চিনতে পারে। কখনো হাক ডাক পেরে নিজেদের পেশার জানান দিয়ে পথ চলি। যাদের অলঙ্কারাদী পানিতে হারিয়ে যায়, তারা আমাদের তা খুঁজে বের করতে বলেন।’

তিনি বলেন, ‘নদী খাল বিলে গোসল বা সাঁতার কাটার সময় অসাবধানতা বশত যে স্থানে কেউ সোনা রূপার অলঙ্কার হারিয়ে ফেলেন। আমরা সে স্থানের চার পাঁচ হাত দূর পর্যন্ত লোহার আচড়া দিয়ে আঁচড়ে মাটি কাদা একত্রে জমা করে টিনের খাচিতে করে উপরে তুলে আনি। এর পর সে কাদা মাটি ধুয়ে অলঙ্কার খুজে বের করার চেষ্টা করি। কখনো পাই কখনো পাই না। এভাবে হাড়ানো অলঙ্কার খুঁজে পেলে পারিশ্রমিক বাবদ অলঙ্কারের মূল্যের তিনভাগের একভাগ আমাদের দেয়া হয়। সোনা বা রূপার অলঙ্কারের ওজন বা মূল্য যত বেশি হয় আমাদের লাভও ততটাই বেশি হয়। যে দিন কাজ পাই না সে দিনগুলোতে আয় তো হয়ই না বরং পকেটের এক দেড় শ’ টাকা খরচ হয়ে যায়।’

তিনি আক্ষেপ করেন, ‘দুঃসময় চলছে। তাই প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হই না। এখন কাজ ও আগের তুলনায় কম পাই। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষের ব্যবসা। আমার বাবা ছিলেন সাপুড়িয়া। পাশাপাশি তিনি এ কাজও করতেন। আমার স্ত্রী তনুজা ব্যাথা বেদনা সাড়াতে মানুষের দেহে সিংগা লাগায়। দাঁতের পোকা ফালায়। ও প্রতিদিন দুই শ’থেকে তিন শ’ টাকা আয় করে। আমি কখনো কাজ পাই, আবার কখনো এক নাগাড়ে অনেক দিন কাজ পাই না। দুই জনের আয়ে কোনো রকমে দিন চলে যাচ্ছে।’

ইকরাম-তনুজা দম্পতির দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে আরিফাকে বিয়ে দিয়েছেন। জামাই তরিকুল ও ডুবুরী পেশায় নিয়োজিত। ছোট মেয়ে ও ছেলে স্কুলেই যায়নি কখনো। মা-বাবা যখন কাজে বেরোয়, তখন তারা বাড়ি পাহাড়া দেয়। কেবল ইকরাম-তনুজা নয়, সাভার ও বিক্রমপুর থেকে এসে যে ১০-১৫টি ডুবুরী পরিবার চাটমোহরে বসতি গড়ে তুলেছেন তাদের প্রায় সবারই একই অবস্থা। ছেলে-মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে। জমা জমি নেই বললেই চলে। স্বচ্ছলতার বালাই নেই, তাদের বেশ ভূষায়। শিক্ষা বঞ্চিত শিশুরা অপুষ্টির মধ্য দিয়ে কিছুটা বড় হয়ে আসছে পৈত্রিক পেশায়। শিক্ষার আলো না থাকায় অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন তারা। তাদের এ বৃত্তের বাইরে আসার প্রতীক্ষা আর কত দীর্ঘ হবে?


আরো সংবাদ



premium cement