২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সজনে আবাদে সুফল পেতে শুরু করেছে চাষীরা

সজনে আবাদে সফল চাষী রমজান - ছবি : নয়া দিগন্ত

সজনে গাছকে বলা হয় পুষ্টির ডিনামাইট। সজনে গাছের পাতাকে বলা হয় অলৌকিক পাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর হার্ব। গবেষকরা সজনের পাতাকে বলে থাকেন নিউট্রিশন্স সুপার ফুড। এটি পুষ্টি ও ওষুধি গুণাগুণের কারণে সবার পরিচিত। এই সজনের আবাদে ঝুঁকে পড়েছে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী গ্রাম। সজনে ও বারোমাসি সজনে এই দু’ জাতের আবাদ শুরু হয়েছে। বড় ধরণের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলনের সহ এর বাজার দর ভাল থাকে। এ চাষের সাথে জড়িতরা গ্রামীন অর্থনীতিতে দিন বদলের পালা চাঙ্গা হবে। পাল্টে যাবে তাদের জীবনযাত্রার মান। এই আবাদের সাথে জড়িতরা ইতোমধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করেছেন।

উপজেলা কৃষি অফিসের সুতে জানা গেছে, সজনে গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করে কার্টিং রোপণ করা হয়। বসতবাড়ি, রাস্তার ধার সহ যে কোনো স্থানের মাটিতে তিন মিটার দূরত্বে রোপন করা যায়। রোপনকালে গোবর সার এবং দ্রত শিকড় গজানোর জন্য সামান্য ফরফরাস সার ও ছাই ব্যবহার করা উত্তম। প্রচলিত কার্টিং পদ্ধতি ছাড়াও চারা রোপণের মাধ্যমে সজনে চাষের আবাদ করা যায়। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সজনে গাছের সংখ্যা ও উৎপাদন। সজনে ডাটা প্রধানত দুই প্রজাতির। এর মধ্যে এক প্রজাতির সজনে বছরে একবার ফলন পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে আরো একটি প্রজাতির নাম বারোমাসি সজনে বা নজনে। বছরে তিন-চার বার ফলন পাওয়া যায়। সজনে গাছ যে কোনো পতিত জমি, পুকুর পাড় রাস্তা বা বাঁধের ধারে যে কোনো ফাঁকা জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে লাগানো যায়। গাছের ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে রাখলেই সজনে গাছ জন্মায়। সজনে গাছের কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। অযত্ন অবহেলায় প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে গাছ। এখন বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরি করে জমিতে রোপন করা হচ্ছে। বড় ও মাঝারি ধরনের একটি গাছে তিন থেকে চার মণ পর্যন্ত সজনে পাওয়া যায়। আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলন হয়ে থাকে।

উপজেলার হাউলী গ্রামের নুর হকের ছেলে রমজান (৫৫) নামের এক সজনে চাষী বলেন, গ্রামের দো রাস্তা নামক মাঠে ১২ কাঠা জমিতে বারো মাসি জাতের সজনে বা নজনে নিজে চারা তৈরি করে গত বছর আবাদ শুরু করেছি। এই আবাদে উভয় জাতের সজনের ডাটার চেয়ে পাতার চাহিদা বেশি ছিল। ইতোমধ্যে ১০ টাকা কেজি দরে ৪০ হাজার টাকার মত পাতা বিক্রি করেছি। তবে বারোমাসি সজনের পাতার চেয়ে ডাটা আবাদে অধিক লাভজনক। রোগ বালাই কম। গাছের কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। অযত্ন অবহেলায় প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে। তাই এবার বারোমাসি সজনের পাতা বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে ডাটা করার চিন্তা করছি। ইতোমধ্যে বারোমাসি কয়েকটি সজনের গাছের ডালে ফুল ফুটেছে। আগাম ফুল ফোটার গাছগুলোতে ডাটা এসেছে। ডাটার গঠন লম্বা ও চেহারা খুব সুন্দর দেখা দিয়েছে। প্রতিটি ডাটা প্রায় দেড় হাত করে লম্বা হয়েছে। বারোমাসি সজনে আগে পিছে ফুল আসার কারণে ডাটা রুপান্তর হয়ে থাকে আগে পিছে। এ চাষে আমার ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রায় সারা বছর ফলন পাওয়ার কারণে এ চাষে পাতার চেয়ে ডাটায় লাভের পরিমান বেশি। গ্রামে অনেকে আমার মত সজনের আবাদ শুরু করেছে।

দামুড়হুদা বাজারের সবজি ব্যবসায়ী সামসুল বলেন, স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন হাট বাজারে সজনে ও নজনে ডাটার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মুখো রচক ও পুষ্টিগুইে ভরপুর সজনে ডাটা স্থানীয়ভাবে বিক্রির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বাজারে অন্যান্য সবজির চেয়ে উঠতি সজনের দাম আকাশ চুম্বী থাকে। বারোমাসি সজনে বা নজনে বাজারের সব সময় কমবেশি পাওয়া যায়। এখন ৮০/৯০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমী সবজি সজনে ও নজনে সব সময় চাহিদা থাকে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকতা আবু হেনা মোঃ জামাল শুভ বলেন, সজনে সবজিতে ক্যালসিয়াম, খনিজ লবণ আয়রণসহ প্রোটিন ও শর্করা জাতীয় খাদ্য রয়েছে। এ ছাড়া ভিটামিন এ বি সি সমৃদ্ধ সজনে ডাটা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারি। শরীরের পুষ্টির জন্য গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে বলে সজনে ডাটা ওষুধি সবজি হিসাবেও এর চাহিদা আছে। এছাড়া গাছের বাকল ও পাতা রক্তামাশায় পেটের পিড়া, উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ কার্যকর ভূমিকা রাখে। সজনের কচি পাতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সজনের বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ওষুধি গুণ আছে। সজনে বাতজ্বর চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। পোকার কামড়ে অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে সজনে পাতার রস ব্যবহার হয়। মাথা ব্যথায় সজনের কচিপাতা কপালের দুই পাশে ঘষলে ব্যথা উপশম হয়। সজনে গ্যাস্টিক রোগের বায়ুনাশক হিসেবে কাজ করে। পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়। শ্বেতীরোগ, টাইফয়েড জ্বর, প্যারালাইসিস এবং লিভারের রোগে সজনের রস উপকার। ক্ষতস্থান সারার জন্য সজনে পাতার পেষ্ট কার্যকরি। খাদ্যাভাসে সজনে গাছের পাতায় চোখের ছানি পড়া রোগ কম হয়। সজনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা এবং মাইগ্রেন চিকিৎসায় সজনে ভাল কাজ করে। ভারত, চীনসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সজনে পাতার পাউডার দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল বাণিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করছে। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনাহার ও অপুষ্টি শিকার মৃত প্রায় রোগাক্রান্ত শিশুদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য সজনের পাতা ও পাতার গোড়া খাওয়ানোর কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষিবিদ ও কৃষি কর্মকতা মোঃ মনিরুজামান বলেন, বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন সজনের পুষ্টিগুণ ব্যতিক্রমধর্মী। আমিষের অনুপাত বিবেচনায় সজনের গাছকেই পৃথিবীর সেরা গাছ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর পাতায় ৩৮ রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮ শতাংশ আমিষ রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সজনের পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজনে পাতায় কমলা লেবুর সাতগুণ ভিটামিন সি, দুধের চারগুণ ক্যালসিয়াম এবং দুইগুণ আমিষ, গাজরের চারগুণ ভিটামিন ‘এ’, কলার তিনগুণ পটাসিয়াম, পালংশাকের তিনগুণ লৌহ বিদ্যমান। পুষ্টি ও ওষুধী গুণ বিবেচনায় এই গাছকে বাড়ির আঙ্গিনায় এটি একটি মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ।

দামুড়হুদা উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া সজনে চাষের উপযোগী। এখানে ব্যাণিজ্যিকভাবে সজনে চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফলে অনেকে আম, জাম, কাঠাল লিচু বাগানের মত এখন বিনা খরচে অধিক আয়ের জন্য অনেক সবজি চাষী ব্যাণিজ্যিকভাবে সজনে চাষে আগ্রহী হয়ে আবাদ শুরু করেছে। তা ছাড়া উপজেলার কুড়–লগাছি, লোকনাথপুর ও ডিসি ইকো পার্কে উপজেলা পরিষদের মধ্যে সজনের ডাল রোপন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সব ধরণের পরামর্শের কৃষি বিভাগের দরজা খোলা রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement