২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঝুড়ি দিয়ে মেপে চলে টাকার লেনদেন

ঝুড়ি দিয়ে মেপে চলে টাকার লেনদেন - ছবি : সংগ্রহ

খুলনার ক্লাবগুলোতে অনেক বছর ধরে খোলামেলাভাবেই চলছে জুয়া ও মরণ নেশা মাদকের বাণিজ্য। জুয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আয়োজক চক্র।

খুলনার ক্লাবে জুয়া ও মাদকের বাণিজ্য কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

এদিকে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে জুয়া ও মাদকের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযানের খবরে খুলনার ক্লাবপাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক । ইতোমধ্যেই খুলনার অধিকাংশ ক্লাবে জুয়ার বোর্ড ও মাদকের আড্ডা বন্ধ হয়ে গেছে। আতঙ্কে রয়েছে ক্লাবগুলোর পরিচালকরা। গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে জুয়াড়ী ও মাদক ব্যবসায়ীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনার সার্কিট হাউজ মাঠ সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন ক্লাব অবস্থিত। এরমধ্যে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়া চক্র, ইয়াং বয়েজ ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, উইনার্স ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি। নগরীর ৭টি ক্লাবে ক্রীড়া উন্নয়নের নামে চলে আসছে অবৈধ জুয়ার আসর, সেই সঙ্গে মাদকের ছড়াছড়ি। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট থেকে জুয়ারীরা প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে এ সকল ক্লাবে জুয়া খেলতে আসেন। সারা রাত ধরেই চলে এ আসর। প্রশাসনের চোখের সামনেই এসব অপকর্ম চললেও নেওয়া হয়না কোনো ব্যবস্থা।

সূত্র মতে, এর মধ্যে আবাহনী, ব্রাদার্স এবং ইয়ং বয়েজ ক্লাবে সর্বাধিক সংখ্যক জুয়াড়ীর আগমন ঘটে। চালানো হয় কাটিং বোর্ড। আড্ডা জমে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের। টাকা গুনতে সময় লাগবে বলে এক ধরনের প্লাস্টিকের ঝুড়িতে করে টাকা পরিমাপ করে লেনদেন চলে। আর অন্য ক্লাবগুলোতে চালানো হয় কাচ্চু, হাইড্রো গেম ও হাউজি। রাতভর এসব ক্লাব থাকে জমজমাট। অনেকেই জুয়ায় আসক্ত হয়ে সব অর্থ খুঁইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। আবার অনেকেই বাড়িঘর ভুলে ডুবে থাকে নেশায়।

এসব ক্লাবের সামনে প্রায়ই জুয়াড়িদের স্ত্রী-সন্তানদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। স্বজনদের খোঁজে এলেও তাদের ক্লাবের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। অপমান-অপদস্থ করে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এসকল ক্লাবে জুয়ার আসরের নিয়ন্ত্রণ করছেন শাসকদলের নেতা পরিচয়ের কিছু মানুষ। তবে তাদের সহযোগিতায় থাকেন কিছু পেশাদার জুয়ার বোর্ড পরিচালনাকারী ও মাদক সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও খুলনায় বিশেষ পেশার কিছু সংগঠনের নামে দেদারছে চলে মাদক ও জুয়ার আসর। প্রতিদিনই এসকল আসরে নিরাপদে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।

ক্লাবপাড়ার একাধিক সূত্র জানান, আবাহনী ক্লাবে জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করে কালা মনির ও মিজান। ইয়ং বয়েজে জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করে আলী ক্লাবের আলী ও সুজন। কয়েক মাস আগে এ ক্লাব এলাকা থেকে পুলিশ তিন শ’ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। ব্রাদার্স ক্লাবের জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করে দেলোয়ার, কেরোসিন বাবু, ইশারাত ও বাদল।

এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব এলাকা থেকেও উদ্ধার করা হয় ৪ শ’ পিস ইয়াবা। যদিও এসব ক্লাবের শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন খুলনার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতারা। আছেন কেসিসি’র বর্তমান তিন কাউন্সিলর এবং সাবেক দু'জন প্রতিনিধিও।

২০১৭ সালে র‌্যাব-পুলিশের পৃথক দু’টি অভিযানে এ সকল ক্লাবে মাদক ও জুয়ার ভয়াবহ এ চিত্র সকলের নজরে এসেছিলো। তবে ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেকের দাবি এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তা না হলে এই মাদক ও জুয়ার প্রভাব ক্লাব পাড়া থেকে মাঠে ময়দানে ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েই যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্রীড়াঙ্গণে জড়িত অনেকে জানান, এ সকল ক্লাবে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাস, হাউজিসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা চলে। সম্প্রতি খেলাধুলার দিকে নজর না দিয়ে মাদক ও জুয়ার আখড়ায় পরিণত হয়েছে অধিকাংশ ক্লাব ভবন। নগরীতে র‌্যাব, ডিবি, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদক বিরোধী কঠোর অভিযানের কথা শোনা গেলেও এ সকল ক্লাবগুলোতে নজর দিচ্ছেন না কেউ। নিরাপদ ও কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই এখানে মাদকের কারবার চলছে বছরের পর বছর।

খুলনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম বাহার বুলবুল বলেন, খুলনার ক্লাবপাড়ায় জুয়া ও মাদকের কোনো কারবার চালাতে দেয়া হবে না। ইতোমধ্যেই এসব অপকর্ম বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্টদের ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে। এরপরও কেউ চালালে কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

খুলনার জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ক্লাবে রাতভর জুয়া ও মাদকের বিষয়টি খেলাধুলার বিরুদ্ধে এক প্রকার হুমকী। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির পিপিএম বলেন, জুয়া ও মাদকের বিষয়ে কোন আপোষ নেই। যেখানেই এ ধরনের খবর মিলবে সেখানেই অভিযান চলবে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৯ মার্চ খুলনার ইয়াং বয়েজ ক্লাবে র‌্যাবের অভিযানের পর এ চিত্র কিছুটা সামনে আসে। সেদিন বিকেল ৩টার দিকে মাদারীপুরের পাট ব্যবসায়ী মো. সুমন ও আতিয়ার সার্কিট হাউস মাঠের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে যাচ্ছিলেন। এ সময় ৭/৮ জন সন্ত্রাসী তাদের দু’জনের গতিরোধ করে ডিবি পরিচয়ে ইয়াং বয়েজ ক্লাবের ভিতরে নিয়ে যায়। পরে তাদের কাছে থাকা পাট ক্রয়ের তিন লাখ টাকা ও একটি পালসার মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়। এরপর ওই দুইজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিন শ’ টাকার ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেয়। বিষয়টি জানতে পেরে র‌্যাব-৬’র অভিযানে ওই ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ৬ জনকে গ্রেপ্তারসহ ক্লাব অভ্যন্তরের কক্ষে থেকে বিদেশী মদ ও ইয়াবা ও মাদক সেবনের বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

একই বছরের ২৫ জুলাই সদর থানা পুলিশ খুলনার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে অভিযান চালায়। এ সময় ২২৫ পিস ইয়াবাসহ রবিউল ইসলাম ওরফে মাখন (২৪) নামের একজন মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সাথে সাথে এছাড়া ইয়াবা বিক্রির ২২ হাজার ৮ শ’ ৯০ টাকা জব্দ করা হয়। গত ২৫ জুলাই এ ঘটনায় সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। সে ৯নং আলতাপোল লেনের বাসিন্দা আজিজুর রহমান ওরফে আলতাপ হোসেনের ছেলে।
সূত্র : ইউএনবি

 


আরো সংবাদ



premium cement