১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা পরিস্থিতিতে দোয়া ও মুনাজাত শেষে মুখমণ্ডল মাসেহ করা

-

দেশে করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে মসজিদগুলোতে মুসল্লির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। ইমাম সাহেবরাও নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে করোনার আক্রমণ থেকে মুক্তি কামনা করে দীর্ঘক্ষণ দোয়া মুনাজাত করছেন। এ সময় তারা মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করছেন। অন্য দিকে করোনাভাইরাসের আক্রমণ রোধ করার জন্য স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা হাত দ্বারা নাক চোখ মুখমণ্ডল স্পর্শ করতে নিষেধ করছেন। এ অবস্থায় মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ না করলে কি শরিয়তবিরোধী কাজ হবে? এ ধরনের প্রশ্ন করছেন অনেকই।
এটা সত্য যে রাসূল সা: থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে সব মুসল্লির নিয়ে একসাথে মুনাজাত করার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও অসংখ্য বার একাকী নফল নামাজ শেষে, আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠান শেষে, জুমার খুতবার সময় এবং এস্তেকার নামাজে হাত তুলে মুনাজাত করার প্রমাণ রয়েছে। তবে দোয়া ও মুনাজাত শেষে কোনো সহিহ হাদিসে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করার প্রমাণ মিলে না। এ জন্য এমনটি করা ফরজ বা ওয়াজিব নয়। সুতরাং বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের কথা মেনে চলে মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ না করাই সমীচিন হবে।
অনেক আলেমের মতে মুনাজাত শেষে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করার নিয়মটি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: থেকে দু’টি মারফু হাদিস এবং ইবন আব্বাস রা: থেকে একটি আসর বর্ণিত হলেও সে হাদিসগুলো মুহাদ্দিসদের মতে সহিহ নয়।
প্রথম হাদিসটি ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত। তাতে আছে, ‘রাসূল সা: যখন দোয়া করার সময় নিজের হাত দুটো তুলতেন তখন তা দ্বারা নিজের মুখমণ্ডল মাসেহ না করে নামাতেন না।’ এ হাদিসটি তিরমিজি বর্ণনা করার পর বলেন, এটি একটি সহিহ গরিব হাদিস। আমরা এটি কেবল হাম্মাদ ইবন ঈসার সূত্রে বর্ণিত হাদিস হিসেবে জানি। তিনি তা একাই বর্ণনা করেছেন। তিনি খুব অল্পসংখ্যক হাদিসই বর্ণনা করেছেন। পরে মানুষ তার থেকেই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।’ শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানি তিরমিজি শরিফের টিকায় হাদিসটি দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন।’ [তিরমিজি, খ-৫, পৃ-৪৬৩, হা: ৩৩৮৬]
দ্বিতীয় হাদিসটি সায়েবের বাবা ইয়াজিদ ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তাতে আছে, ‘রাসূল সা: যখন দোয়া করতেন তখন তার হাত দুটো তুলতেন তার পর হাত দুটো দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করতেন।’ [আবু দাউদ, খ-২, পৃ-৭৯, হা:১৪৯২; শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানি আবু দাউদের টিকায় হাদিসটি দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। শায়খ শোআইব আরনুউতও মুসনাদে আহমদ খ-২৯, পৃ-৪৬২, হা:১৭৯৪৩ এর টিকায় হাদিসটি দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন।]
তৃতীয় হাদিসটি ইবন আব্বাস রা:-এর উক্তি হিসেবে বর্ণিত। তাতে আছে, ‘যখন দোয়া করবে তখন তোমার দুই হাতের ভেতরের অংশ দ্বারা দোয়া করবে, আর যখন দোয়া শেষ করবে তখন তোমার হাত দ্বারা তোমার মুখমণ্ডল মাসেহ করবে।’ [হাসান ইবন আহমদ ইবন ইউসুফ আস সানাআনি বলেন, এ হাদিসটি আবু দাউদ, খ-২, পৃ-৭৮, হা: ১৪৮৫; ইবন মাজাহ, খ-১, পৃ-৩৭৩; খ-২, পৃ-১২৭২, হা: ৩৮৬৬ ¡১১৮১ বর্ণনা করেছেন। আবু হাতেম বলেছেন এটি একটি মুনকার হাদিস। আবু দাউদ বলেছেন, এর সব সনদ অতি দুর্বল। দেখুন, ফাতহুল গফ্ফার আল জামে লি আহকামি সুন্নাতি নবিয়্যিনা আল মুখতার, খ-৪, পৃ-২৯৩]
এ কারণেই বহু আলেম দোয়া ও মুনাজাত শেষে মুখমণ্ডল মাসেহ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন :
ক. ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল বলেন, ‘এটা জানা যায় না যে, রাসূল সা: দোয়া শেষে মুখমণ্ডল মাসেহ করতেন। কেবল হাসান বাসরি তা বলেছেন। [আল ইলাল আল মুতানাহিয়্যা, খ-২, পৃ-৮৪০-৮৪১]
খ. শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া বলেন, ‘নবী সা: দোয়াতে তার হাত তুলতেন সে প্রসঙ্গে বহু সহি হাদিস বর্ণিত আছে। তবে তার দুই হত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ প্রসঙ্গে একটি বা দুটো হাদিস বর্ণিত আছে, সে হাদিস দুটোও দলিল দানের উপযুক্ত নয়’। [মাজমু আল ফাতাওয়া, খ-২২, পৃ-৫১৯]
গ. ইজ্জ ইবন আবদুস সালাম বলেন, ‘অজ্ঞ মানুষ ছাড়া আর কেউ দোয়ার পরে নিজের হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করে না।’ [ফাতাওয়া ইজ্জ ইবন আবদুস সালাম, পৃ-৪৭]
ঘ. শায়খ আবদুল্লাহ বিন বায বলেন, ‘হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করা প্রসঙ্গে কোনো সহিহ হাদিস নেই। সে বিষয়ে কিছু হাদিস আছে, যা দুর্বলতা মুক্ত নয়। এ কারণেই সঠিক ও বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে দোয়াকারী নিজের হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করবে না।’[ আল ফাতাওয়া, খ-২৬, পৃ-১৩৮]
ঙ. শায়খ মুহাম্মদ ইবন ছালেহ আল উসাইমীন বলেন, ‘দোয়া শেষে হাত দ্বারা মুখণ্ডল মাসেহ করা প্রসঙ্গে সঠিক কথা হলো তা শরিয়তসম্মত নয়। কারণ এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদিসগুলো দুর্বল। এমনকি ইবন তাইমিয়ার মতে তা দলিল দানের উপযুক্ত নয়।... দোয়া শেষে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করা প্রসঙ্গে আমার অভিমত হলো তা সুন্নত নয়। এটি জানা কথা যে নবী সা: জুমার খুতবার সময়, এস্তেকার নামাজে হাত তুলে দোয়া করতেন। তাতে এমন কোনো সহিহ বর্ণনা নেই যে তিনি তার হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করেছিলেন। আরো বেশ কিছু হাদিসে বর্ণিত আছে যে, নবী সা: দোয়া করেছিলেন আর তাতে হাতও তুলে ছিলেন। তবে এ কথার প্রমাণ নেই যে তিনি তখন মুখমণ্ডল মাসেহ করেছিলেন।’ [মাজমু ফাতাওয়া ইবন উছাইমিন, খ-১৪, পৃ-৭৮১]
ছ. শায়খ ছালেহ আল মুনাজ্জিদ বলেন, ‘দোয়া শেষে মুখমণ্ডল মাসেহ করা শরিয়তসম্মত নয়। নবী সা: তাঁর রবের কাছে দোয়া করতেন তা মুতাওয়াতির সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। তাতে দোয়া শেষে তিনি তার হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করার কথা প্রমাণিত নয়।’ [আল ইসলাম সাওয়াল জবাব, ফাতাওয়া নং-৩৯১৭৪, তা: ১৯/০৩/২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ।
সুতরাং বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মসজিদে জামাতের নামাজ আদায় করার পর দোয়া শেষে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ না করলে কোন ক্ষতি হবে না।
ড. মাহফুজুর রহমান, প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 


আরো সংবাদ



premium cement