২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

কাক্সিক্ষত আদর্শের বৈশিষ্ট্য

-

কোনোরকম সন্দেহ বা দ্ব্যর্থতা ছাড়াই একটি বিষয়ে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য নৈতিক বিকাশের মূল চাবিকাঠি ঈমানভিত্তিক শিক্ষা ছাড়াও সুদৃঢ় আদর্শিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। এটি হবে ইতঃপূর্বে বর্ণিত ফিকহভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যা আগামী দিনের আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন।
আমাদের কাছে ঈমান যুক্তি বা বুদ্ধির পরিপন্থী নয়। বরং ঈমান যুক্তিভিত্তিক ও যুক্তি দ্বারা চালিত এবং কুরআনে মুমিনদের বুদ্ধিমান মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন তাদের জন্যই দিকনির্দেশক যারা বুদ্ধিমান ও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে। উম্মাহর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের কাছে যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সব ওহির জ্ঞান। কেননা, ওহির জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর অস্তিত্ব কিংবা রিসালাতের বৈধতা প্রমাণ করা যায় না। কুরআনে বর্ণিত নির্দেশাবলি যৌক্তিক মানসিকতা নির্মাণ করে যা ইবাদতের ভিত রচনা করে এবং সব কুসংস্কার ও পূর্বপুরুষদের অথবা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুকরণকে নাকচ করে দেয়।

বিজ্ঞানসম্মত আদর্শ
যে আদর্শের ভিত্তিতে আমরা কাক্সিক্ষত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাই তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। শিক্ষকদের উচিত হবে এসব বৈশিষ্ট্যের অনুধাবন ও বাস্তবায়ন করা। আর শিক্ষা পাঠ্যক্রমে এসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে হবে।
পূর্ণ আক্ষরিক অর্থে এ শিক্ষা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। বিজ্ঞানভিত্তিক বলতে আমি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞান সম্পৃক্ত বিজ্ঞানকে বোঝাতে চাইনি। যদিও মুসলমানদের বিজ্ঞানের এসব বিষয় নিয়ে চর্চা করা উচিত। কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ যেখানে প্রমাণ ছাড়া কোনো দাবি, প্রস্তাবনা ছাড়া কোনো ফলাফল, দলিল ছাড়া কোনো সাক্ষ্য অথবা সম্পূর্ণরূপে সন্দেহমুক্ত না হলে কোনো প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আমরা চাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারা ও বৈজ্ঞানিক চেতনা যা আমাদের পথ দেখাবে, যেন আমরা যেকোনো বিষয়, ইস্যু, পরিস্থিতি ও মানুষকে বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় বিবেচনা করতে পারি এবং আবেগ, তাৎক্ষণিকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, গোষ্ঠীস্বার্থ এবং প্রাত্যহিক নানা অজুহাতের প্রভাবমুক্ত হয়ে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নিয়ে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। উপরোক্ত প্রতিকূল দিকগুলো আমাদের আচার-আচরণ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তি তার অথবা তার দলের খেয়াল-খুশির প্রভাবে চালিত হলে জনগণ যা পছন্দ করে তাই করে তাদের তোষণ করতে চাইবে, স্বদেশ ও সামগ্রিকভাবে জাতির ভবিষ্যতের জন্য যা কল্যাণকর সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না।


দরকার বৈজ্ঞানিক চেতনা
বৈজ্ঞানিক চেতনার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : ১. কোন উৎস থেকে এসেছে সে দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে বিভিন্ন বিষয়, পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ। হজরত আলী রা: বলেছেনÑ ‘মানুষকে দিয়ে সত্য জানার চেষ্ট করো না, বরং সত্য কী প্রথমে সেটাই জানো, তাহলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষকে সহজেই চিনতে পারবে।’
২. স্পেশালাইজেশনকে গুরুত্ব দেয়া। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘সুতরাং, কিতাবের বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের জিজ্ঞাসা করো (সূরা নাহল : ৪৩), তার সম্পর্কে যিনি অবগত তাকে জিজ্ঞাসা করো (সূরা ফুরকান : ৫৯) আর তোমাকে সর্বজ্ঞ আল্লাহর ন্যায় কেউই অবহিত করতে পারবে না’ (সূরা ফাতির : ১৪)।
দ্বীনের নিজস্বতা আছে। যেমন আছে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বিশেষ করে আমাদের এ যুগে। যে ব্যক্তি দ্বীন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে জ্ঞান রাখে এবং সব বিষয়ে মতামত দেয়, সে তো বাস্তবপক্ষে কিছুই জানে না।
৩. আত্মসমালোচনা, ভুল স্বীকার, এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং স্পষ্টভাবে অতীতের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনার আগ্রহ থাকতে হবে। আত্মতুষ্টি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা, তা অতীতকে কেবল গৌরব ও বিজয়ে পূর্ণ দেখতে পায়।
৪. সফলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বাধুনিক ও সর্বোত্তম কৌশল প্রয়োগ এবং শত্রুসহ অন্য সবার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা। জ্ঞান মুমিনদের হারানো সম্পদ, তা যেখান থেকেই পাওয়া যাক না কেন। অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে মুমিনই সে জ্ঞানের বেশি হকদার।
৫. কেবল অকাট্য ধর্মীয় ও আদর্শিক তত্ত্ব ছাড়া সব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং তার ফলাফল কারো পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা না করেই গ্রহণ করা।
৬. সিদ্ধান্ত ও মতামত প্রদানে তড়িঘড়ি না করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের আলোকে সতর্ক পর্যালোচনা এবং অপর পক্ষের সাথে গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার পরই কেবল একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে আলোচ্য বিষয়ের ভালো-মন্দ সব কিছুই সামনে চলে আসবে।
৭. ফিকহের বিভিন্নমুখী ইস্যু এবং জ্ঞানের সব শাখায় যারা বিপরীত ধারণা পোষণ করেন, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা; যতক্ষণ প্রতিটি বিষয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে যুক্তি প্রমাণ থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিষয়টি এমনভাবে মীমাংসা করা যাতে বিরোধ এড়ানো যেতে পারে। আমাদের আলেম সমাজ রায় দিয়েছেন ইজতিহাদভিত্তিক মতামতের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। সেহেতু কেউ ইজতিহাদভিত্তিক মতামত দিলে তাকে অন্যের চেয়ে উত্তম গণ্য করা উচিত হবে না। তবে ইজতিহাদের মাধ্যমে গঠনমূলক আলাপ-আলোচনা এবং সহনশীল ও আন্তরিক পরিবেশে তাত্ত্বিক ও পক্ষপাতহীন যাচাই-বাছাই বন্ধ হওয়া উচিত নয়।

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিরোধী রীতি
জটিল বিষয় অতি সরলীকরণ, গুরুতর ইস্যু অবমূল্যায়ন, কঠিন সমস্যা হালকা করে দেখা অথবা প্রধান প্রধান ইস্যু অশিক্ষিত লোকের মতো এবং দরবেশি আচার-আচরণ দিয়ে মোকাবেলা করা বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার পরিপন্থী।
অদৃশ্য হাত ও অশুভ বিদেশী শক্তি আমাদের দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য দুর্বৃত্তের মতো নীলনকশা তৈরি করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না আমরা নিজেরাই সেই ফাঁদে পা দেই। এ অবস্থায় আমরা সব কিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পাই এবং মনে করি, এসব অশুভ চক্রের মোকাবেলা করার মতো শক্তি আমাদের নেই। অতএব হাত গুটিয়ে নেয়াই ভালো। এ ধরনের মন-মানসিকতা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি সত্য হতে পারে; কিন্তু এটিকে ঢালাও ব্যাপার বলে মনে করা ভুল। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের এরূপ ব্যাখ্যা বস্তুত ষড়যন্ত্র ও নীলনকশারই ফল। এসব ঘটনা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক যাই হোক না কেন, উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করার দু’টি খারাপ ফল রয়েছে :
প্রথমত, এ ধরনের মনোভাব বৃদ্ধি পেলে তা এক ধরনের অদৃষ্টবাদের জন্ম দেবে, যেন এসব শয়তানি চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ এসব দুষ্টচক্রের বিপুল আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার কাছে আমরা অতিশয় দুর্বল ও হীনবুদ্ধি। এভাবে আমরা দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হই। এরূপ চিন্তাভাবনা কেবল হতাশা ও পরাজয়ের ধ্বংসাত্মক মনোভাবই সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয়ত, এ মানসিকতা আমাদের আত্মসমালোচনা বিমুখ করে এবং দোষত্রুটি অনুধাবন, সমস্যার প্রতিকার কিংবা ব্যর্থতা ও অপরাধ খতিয়ে দেখার কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর আগ্রহ সৃষ্টি করে না। ফলে রোগের কারণ নির্ণয় করে নিরাময়ের চেষ্টাও বিঘিœত হয়। যতদিন পর্যন্ত আমরা মনে করব আমাদের দুর্বলতা, ঔদাসীন্য, দুর্নীতি কিংবা ধ্বংসের কারণ দুষ্ট বৈদেশিক চক্রান্ত, আমাদের নিজ আচরণের ফলে নয়, ততদিন এ অবস্থা বিরাজ করবে।
‘আমরা প্রায়ই এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করি অথচ কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আমরা কখনো দুর্ভাগ্য, দুর্যোগ ও পরাজয়ের সম্মুখীন হলে কেবল নিজেদেরই দোষী মনে করতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘আর তোমাদের ওপর যেকোনো বিপদ আপতিত হয়, তা তোমাদেরই হস্তের অর্জিত কার্যকলাপের দরুণ। আর অনেক বিষয় তো তিনি মাফ করে দেন’ (সূরা শূরা : ৩০)।
ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা তাদের ৭০ জন বীর যোদ্ধাকে হারিয়ে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়েছিল। অথচ এ মুসলিম বাহিনীই বদরের যুদ্ধে এক দীপ্তিময় বিজয় অর্জন করেছিল। তারা নিজেদের কাছে নিজেরাই এর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে আল্লাহ তায়ালা এর জবাব পাঠান এভাবেÑ ‘তোমাদের এ কি অবস্থা তোমাদের ওপর যখন একটি মুসিবত ঘনিয়ে এলো, যদিও একবার তোমরাই তোমাদের শত্রুদের ওপর দ্বিগুণ আঘাত হেনেছিলে, তোমরা বলেছ, এটি কোথা থেকে এলো? আপনি তাদের বলুন, এ বিপদ তোমাদের নিজেদের কারণেই এসেছে’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৫)।
অনুবাদ : সানাউল্লাহ আখুঞ্জি

 


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী

সকল