২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অর্জিত তাকওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন

-


‘তাকওয়া অর্জন’ শিরোনামে সিয়াম নামক ক্যাম্পে এক মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়েছিল সারা বিশ্বের মুসলিম প্রশিক্ষণার্থীরা। এই তো সবেমাত্র শেষ হলো সেই প্রশিক্ষণ। প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থী ভাইবোনকে একটি মাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তর করা হয়েছে। ক্রমাগত একটি মাস তাকওয়ার অনুশীলনে প্রতিটি প্রাণ এখন উজ্জীবিত। ‘রমজান তো সে মাস, যাতে এ কুরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।’ (আল কুরআন : ১৮৫) তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়ে ভালো-মন্দ, হক-বাতিল, সত্য-মিথ্যা মোট কথা আল্লাহর পথ ও তাগুতের পথ বাছাই করে চলা। কুরআন সেই পার্থক্যের পথ দেখাবে। সুতরাং তাকওয়ার বাস্তব প্রয়োগের জন্য আল কুরআনের প্রাত্যহিক অধ্যয়ন ও অনুশীলন প্রয়োজন। কুরআন অনুযায়ী নিজের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে এটিই হবে তাকওয়ার ধারাবাহিকতা, এটিই হবে তাকওয়ার বাস্তব প্রতিফলন।
তাকওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রকৃত তাকওয়াধারী বা মুত্তাকির অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, রমজানের পর যদি তাকওয়ার ধারাবাহিকতা না থাকে, তবে বুঝতে হবে তার রমজানের সারাদিনের ক্ষুধা, কিয়ামুল লাইল, রাত জাগরণ, ইবাদত কবুল হয়নি। যেকোনো কাজ আগে কাজের সঠিকতার ওপর পরবর্তী কাজটি নির্ভর করে। আল্লাহর ইবাদতের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। একটি ভালো কাজের সওয়াব হচ্ছে, ভালো কাজের পর ভালো কাজ করা। একটি ভালো কাজ করার পর আবার ভালো কাজ করা, প্রথমটি কবুল হওয়ার আলামত। ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। বুখারির একটি হাদিস থেকে তাই জানা যায়, আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে কাজ কেউ সর্বদা (নিয়মিত) করে, সেটিই আল্লাহর কাছে প্রিয়তম।’ (বুখারি : ৪১ সংক্ষেপিত)
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, রমজান আসে, রমজান যায়, আমরা যেখানটায় ছিলাম সেখানটায় আবার ফিরে যাই। কোনো পরিবর্তন বা কোনো প্রতিফলন তো আমাদের চোখে পড়ে না। এর কারণ কী? এটি কি প্রশিক্ষণের ত্রুটি? না কি প্রশিক্ষণার্থীর ত্রুটি? প্রকৃত কারণ হলো, না বুঝে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা। প্রশিক্ষণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা রয়েছে। সেই বিষয়গুলো হলোÑ রমজান, তাকওয়া ও আল কুরআন। সেই ভুলটি হলো, রমজান থেকে আমরা কুরআন ও তাকওয়াকে আলাদা করে চিন্তা করি। যিনি অন্ধ তার কাছে টর্সলাইটের আলোর কোনো মূল্য নেই এবং এ আলো তাকে পথ দেখাতে পারে না। এমনিভাবে আমরা যারা রমজানের রোজাকে আল কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি এবং আল কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে ও মানতে এবং তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে চাই না, তাদের রোজা ও আল কুরআন যৌথভাবে তাকওয়ার পথে পরিচালিত করতে পারছে না। আমাদের দৈনন্দিনের প্রতিটি ইবাদত এবং আল কুরআনের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে আমরা সস্তা সওয়াবের ডিজিট গণনায় মত্ত হয়ে আছি।
রাসূলে করিম সা: বলেছেন, ‘অনেক রোজাদার এমন রয়েছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া ভাগ্যে অন্য কিছুই জোটে না। তেমনি রাতে ইবাদতকারী অনেক মানুষও এমন রয়েছে, যারা রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।’ অন্য হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না, তার শুধু খানা-পিনা না করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
রমজানের তাকওয়ার ধারাবাহিকতা চালু রাখার জন্য যেই কাজটি করতে হবে তা হলোÑ নিজের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। এটাই তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়। কিন্তু মানুষের যদি এ জ্ঞানই না থাকে যে, কিসে তার ক্ষতি, কিসে তার ভালো, তবে সে কিভাবে সেই পার্থক্য নিরূপণ করবে? তাই ভালো-মন্দ যাচাই করার জন্য দরকার একটি কষ্টিপাথর। আল কুরআনই হলো সেই কষ্টিপাথর যার মাধ্যমেই একমাত্র হক ও বাতিল, ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া গুণ সৃষ্টি করা, আল কুরআনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়াসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঠিক পথের দিশা দেয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘আলিফ-লাম-মিম। (এই নাও) সেই কিতাব (আল কুরআন) তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, ইহা মুত্তাকি লোকদের পথ দেখাবে।’ (আল কুরআন : ১-২) তাহলে আমরা এভাবে বলতে পারি, আল কুরআনের কাজ হচ্ছেÑ প্রাথমিকভাবে সৈন্যবাহিনীতে লোক নিয়োগদান করে রমজানের রোজার হাতে ছেড়ে দেয়া এবং রমজানের রোজা একটি মাস তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা তথা দক্ষ সৈনিকে রূপান্তর বা তৈরি করে আবার কুরআনের হাতে সোপর্দ করবে। এবার আল কুরআন তাকে সামনে পথ চলার কর্মসূচি বাতলে দেবে। কুরআন বলবে কোনটি আল্লাহর মর্জির পথ, আর কোনটি তাগুতের পথ। আল্লাহর মর্জির পথ হলো তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর জমিনে তাঁরই অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করা। এটিই রমজান, তাকওয়া ও কুরআনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আল কুরআন হলো রমজানের মধ্যমণি। রমজান তো ফরজ করা হয়েছে আল কুরআনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করার ট্রেনিং হিসেবে। শুধু রমজান নয়, এমনিভাবে আমরা যতগুলো ইবাদত পালন করে থাকি যেমনÑ নামাজ, জাকাত ও হজ প্রতিটি ইবাদতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো সেই একটিই, আর তা হলোÑ আল কুরআন অনুশীলনের সংগ্রামে একজন আদর্শ সৈনিকে পরিণত করা।
মনে করুন, একজন সৈনিক সেনাবাহিনীর সব রুলস ও রেগুলেশনস প্রতিপালনসহ দৈনিক পাঁচবার প্যারেডে অংশগ্রহণ করে এবং বছরে একবার বিশেষ মহড়াতেও অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়াও অন্য সব শর্ত সে মেনে নিতে রাজি হয়। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সে রাজি নয়। এ ধরনের সৈনিককে বেতনভাতা দিয়ে যেমন কোনো লাভ নেই, তেমনি সব প্রকার ট্রেনিংও তার ভেস্তে যাবে। কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সৈনিকের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি?
রমজান, কুরআন ও তাকওয়া এ তিনটি পরিভাষা একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চক্রাকারে আমাদের মাঝে আবর্তিত হয়। আর সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো ইসলামী সমাজ উপযোগী সৎ নাগরিক তৈরি করা।
সুতরাং, রমজান চলে গেলে এ পবিত্র মাসে আমাদের মধ্যে তাকওয়ার যে শক্তি অর্জিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। যেই তাকওয়া আমাদের আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান এবং কুরআনের মিশনকে পুরো করার যোগ্য করে তুলতে পারে। সে জন্য কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আসুন তাকওয়ার অনুশীলনের জন্য কুরআনকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করি।
একটি তাকওয়াসম্পন্ন জাতির উন্নয়নে আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিনের দ্বার খুলে দেন। এটি আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনত ও তাকওয়া বা ভয় করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সূরা আরাফ : ৯৬)
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement