২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
ব্রাজিলের এস্তাদো দে সাও পাওলো পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রফেসর ইউনূস

করোনা আত্মনিধনের পথ ছেড়ে নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে

ড. মুহাম্মদ ইউনূস - ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন : আপনি লিখেছেন যে, কোভিডের প্রাদুর্ভাবের আগে আমরা খাদের একেবারে কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। আপনার কেন এমনটি মনে হলো? আমরা কিভাবে ও কেন এ জায়গায় পৌঁছালাম?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : মহামারীর অব্যবহিত আগে পরিস্থিতি ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল আমি সেটিই বোঝাতে চেয়েছি। এই মহামারী অর্থনীতির মেশিনটাকে থামিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মহামারী-পূর্ব অবস্থা থেকে পৃথিবী অর্থনৈতিকভাবে অনেক পেছনে পড়ে গেছে। এখন সরকার ও ব্যবসাগুলো জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে, যাতে প্রবৃদ্ধির সেই গতিটা আবারো ফিরে পাওয়া যায়। আমি যেটা জোর দিয়ে বলতে চাইছি তা হলো, এখন আমাদের নীতি হওয়া উচিত মহামারী-পূর্ব সেই পৃথিবীতে আমরা ‘আর ফিরে যেতে চাই না’; কেননা সেটি ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অল্প কিছু লোকের হাতে সম্পদের চরম কেন্দ্রীকরণ এবং পৃথিবীর বুকে মানুষকে অপাঙ্ক্তেয় করে দিয়ে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের আগ্রাসনের মাধ্যমে এই গ্রহে মানুষের অস্তিত্ব ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে ক্রমাগত সতর্ক করে যাচ্ছিলেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীতে আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সময় গণনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মানবজাতি এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদাপন্ন প্রজাতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। মহামারী-পূর্ব পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া হবে আত্মহত্যার শামিল। তা হলে ধ্বংস-অভিমুখী সেই আগের পথে আমরা কেন ফিরে যাবো?

এখন যেহেতু অর্থনীতি থেমে গেছে, আমরা এখন একে সম্পূর্ণ নতুন পথে চালিত করতে পারি। মহামারী আমাদেরকে আত্মহত্যার পথ ত্যাগ করে একটি নতুন পৃথিবীর পথে- একটি তিন শূন্য অর্থাৎ ‘শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ’, ‘শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ’ ও ‘শূন্য বেকারত্ব’-এর একটি নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা জানি কিভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে। যা দরকার তা হচ্ছে আগের পথ পরিত্যাগ করার সাহসী সিদ্ধান্তের।


প্রশ্ন : আপনি বলছেন যে, বর্তমান কাঠামোর একটি পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, যা শুরু হবে সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা দিয়ে। কোনো দেশ এমনটি ভাবছে এবং এ ধরনের কোনো পথ অবলম্বনের চেষ্টা করছে বলে আপনার মনে হচ্ছে কি?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস : কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। আমাদের পুরনো ব্যবস্থা আমাদেরকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা একটি জ্বলন্ত গৃহে বাস করছি। কিন্তু আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা আমাদেরকে এটি বুঝতে দিচ্ছে না। আমরা একটি জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে একটি বড় উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত। আমরা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তির চমক উদযাপন করছি, উন্নয়নের জয়গান করছি; অথচ একেবারেই দেখতে পাচ্ছি না যে, আমাদের এই উৎসব-ই বরং আমাদের গৃহে লাগা আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে।

পৃথিবীর সব দেশেই তরুণ সমাজ এটি বুঝতে পেরেছে, আর এ কারণে তারা রাজনৈতিক দল থেকে দূরে থাকতে চাইছে। কিশোর-কিশোরীরা ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ ব্যানারে একটি নতুন ভবিষ্যতের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তারা তাদের অভিভাবকদেরকে তাদের ভবিষ্যৎ চুরি করে নেয়ার জন্য অভিযুক্ত করছে। সরকারগুলো নিট কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য ঘোষণা করে নিজেদের সচেতনতা আর দায়িত্ববোধ প্রমাণ করতে চাইছে। ব্যবসাগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ওপর চুক্তি স্বাক্ষর করছে। তবে আমরা জানি না এর কতটুকু আসল আর কতটুকু মিডিয়ায় প্রচারের উদ্দেশ্যে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক বর্তমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বদলে ফেলতে আমাদেরকে অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের চিন্তাধারা এরই মধ্যে একটি বিপজ্জনক পৃথিবী গড়ে তুলেছে, যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব সম্পদ উত্তর গোলার্ধের একটি চূড়ায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে আর পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঠাসাঠাসি করে জড়ো হয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধের এক চূড়ায়। দুনিয়ার সব সমৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে উত্তর গোলার্ধে আর দক্ষিণ গোলোর্ধের মানুষদের বলা হচ্ছে এর সাফল্য উদযাপন করতে। বর্তমান ব্যবস্থা সম্পদ ও মানুষের মধ্যকার এই দূরত্ব সফলভাবেই বাড়িয়ে চলেছে।

আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স মানুষকে কাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই মানুষ পৃথিবীর বুকে আবর্জনায় পরিণত হবে; তারা আর কোনো কাজে আসবে না।

সরকারগুলো বরাবরের মতোই তাদের ‘রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ পথ’ অনুসরণ করছে। তারা পরিবেশগত লক্ষ্য ঘোষণা করছে। কিন্তু বেশির ভাগ দেশেই কোনো আশু প্রয়োজনীয়তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে কোনো দেশেই কোনো দুশ্চিন্তা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বর্তমান ব্যবস্থাটাকে আমূল বদলে ফেলে ‘তিন শূন্য’র একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে মানুষকে বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন : আপনি আরো বলছেন যে, পৃথিবীর এই পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে মুনাফাবিহীন ব্যবসা সৃষ্টি করতে হবে। এটি কি পুঁজিবাদ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া নয়?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : পুঁজিবাদ এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, মানুষ সবসময় ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। আমি এ ধারণাকে প্রকৃত মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে একে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে চাচ্ছি। আমার এই নতুন সংজ্ঞায় মানুষ কিছুটা ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা আর প্রধানত সমষ্টিগত স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যক্তিস্বার্থের ওপর সম্পূর্ণ জোর দিয়ে অর্থনীতিবিদরা সে ধরনের ব্যবসা সৃষ্টিতেই ভূমিকা রেখেছেন, যেগুলো মুনাফা সর্বোচ্চ করবে।

সমষ্টিগত স্বার্থ মানুষের অন্যতম লক্ষ্য হলে আমাদেরকে এমন ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যা সমষ্টির বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে বিশেষভাবে উপযুক্ত। যে ব্যবসা সমষ্টির সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট, সেখানে ব্যক্তিগত মুনাফার প্রয়োজন নেই। তার যা প্রয়োজন তা হলো আর্থিকভাবে টেকসই পন্থায় সমষ্টিগত সমস্যাগুলোর সমাধান। আর এ কারণে আমি বিশেষ ধরনের ব্যবসা তৈরি করেছি, যাকে আমি বলছি ‘সামাজিক ব্যবসা’; যে ব্যবসা ব্যক্তিগত মুনাফার অনুসন্ধান না করে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবে। এ ব্যবসার মুনাফা ব্যবসাতেই আবার ফিরে যাবে, ব্যক্তির কাছে নয়।

এটি কি পুঁজিবাদ? এই নতুন তত্ত্বে মুনাফা সর্বোচ্চকারী ব্যবসাগুলো শূন্য ব্যক্তিগত মুনাফার ব্যবসাগুলোর পাশাপাশি ব্যবসা করে যাবে। কে কোন ধরনের ব্যবসা করবে, তা ব্যক্তির পছন্দের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। এই নতুন তত্ত্বে উদ্যোক্তা তিনটি বিকল্প থেকে একটি বেছে নেবেন; তিনি মুনাফা সর্বোচ্চকারী ব্যবসায়ে নিয়োজিত হতে পারেন, কিংবা একটি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন, অথবা এই দুই ধরনের ব্যবসাই সৃষ্টি করতে পারেন। দুই ধরনের ব্যবসাই একই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে, একই বাজারে কাজ করতে পারে।

প্রশ্ন : মুনাফাই যদি না থাকলো তাহলো এই পুনর্বিন্যস্ত দুনিয়ায় মানুষ বিনিয়োগ করবে কেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : আপনি যদি মনে করেন যে, লাভের প্রত্যাশা ছাড়া মানুষ কোথাও অর্থ ব্যবহার করে না, তা হলে আপনি ভুল করছেন। মানুষ বিভিন্ন কারণে অর্থ ব্যয় করে। এর একটি হচ্ছে সেবামূলক কাজে দান, যেখানে দাতা লাভের আশা করেন না।

আপনি যদি ‘বিনিয়োগ’কে ব্যক্তিগত মুনাফা সর্বোচ্চ করার উপায় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, তা হলে আমি এ বিষয়ে একমত হতে পারি যে, কোনো সামাজিক ব্যবসার শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত টাকা ‘বিনিয়োগ’ হবে না। আপনি যদি বিনিয়োগের এই সংজ্ঞা মেনে নেন যে, কোনো কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত টাকা হচ্ছে বিনিয়োগ; তা হলে কোনো সামাজিক ব্যবসার শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত টাকা বিনিয়োগ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

আপরি প্রশ্ন করতে পারেন, মুনাফা সর্বোচ্চ করাই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তা হলে কেউ সামাজিক ব্যবসার শেয়ার কেন কিনতে যাবে?
আমি বিষয়টিকে এভাবে দেখতে চাই- মানুষ সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে; কেননা টাকা রোজগার করা তার কাছে হয়তোবা সুখের হতে পারে, কিন্তু অন্যদের সুখী করাটা হবে তার কাছে পরম সুখের। যদি তাই হয়ে থাকে তা হলে মানুষ তো সামাজিক ব্যবসাতেই বিনিয়োগ করতে চাইবে। প্রকৃতপক্ষে, এসব কিছুরই মূল আমাদের মনের মধ্যে, যেখানে জন্ম হয় সুখের অনুভূতিরÑ মন যেটাকে সুখ হিসেবে দেখে।

আমি আমার টাকা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারি। আমি এটি ভালো কাজে দান করতে পারি, বিছানার নিচে রেখে দিতে পারি, লটারির টিকিট কিনতে পারি, সামাজিক ব্যবসায়ে কিংবা মুনাফা সর্বোচ্চকারী কোনো ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারি, কিংবা আরো নানাভাবে এর ব্যবহার করতে পারি। আমাদের জীবনটা প্রকৃতপক্ষে সুখের সর্বোচ্চকরণ, মুনাফার সর্বোচ্চকরণ নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির তত্ত্ব আমাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভ্রান্ত করেছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপটা হচ্ছে এটি আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, সুখের পরিমাপ হয় টাকার পরিমাণ দিয়েছে।

প্রশ্ন : আপনি আরো বলছেন যে, নতুন পুনরুদ্ধার কর্মসূচিতে নাগরিক ও সরকারের মধ্যে যে শ্রমবিভাজন তা ভেঙে ফেলতে হবে, যেখানে সামাজিক সমাধানের লক্ষ্যে নাগরিকদেরকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। এখানে কি রাষ্ট্রের আকার ছোট করে ফেলার কথা বলা হচ্ছে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : পুঁজিবাদী তত্ত্বে ধরে নেয়া হয়েছে যে, নাগরিকরা তাদের মুনাফা সর্বোচ্চ করতে কাজ করে যাবে আর সরকারকে কর দেবে। সরকার রাজস্বের টাকা দিয়ে দেশের সাধারণ সমস্যাগুলোর সমাধান করবে।

সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার কী মাত্রায় জড়িত হবে তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সরকার সবচেয়ে কম কর ধার্য করবে এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা থেকে দূরে থাকবে। তাদের মতে, সামাজিক ইস্যুগুলোর সমাধান বাজারের শক্তির হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। অন্যরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে এবং সরকার কর ধার্য করে এ জন্য অর্থের সংস্থান করবে।

আমার যুক্তি হচ্ছে, কোনো পরিস্থিতিতেই সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে নাগরিকরা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। বিভিন্ন সামজিক সমস্যার সমাধানে নাগরিকদেরকে অবশ্যই তাদের সব সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধানে নাগরিকরা সক্রিয় হয়ে উঠলে এর ফল পেতে মোটেই বিলম্ব হবে না। যেকোনো বুদ্ধিমান সরকারকেই সমাজের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দেশের নাগরিকদেরকে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। সরকারের কাজ হবে নাগরিকদের উৎসাহিত করা, তাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়া, তাদের অর্জনের প্রশংসা করা এবং নাগরিকদের বিভিন্ন উদ্যোগে সহায়তা দিতে উপযুক্ত আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে দেয়া। এ ছাড়াও সরকার সামাজিক ব্যবসা ফান্ড ও সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড গঠন করতে পারে এবং সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা উৎসাহিত করতে আইনি কাঠামো তৈরি করে দিতে পারে।

আমি সরকারের গুরুত্ব ছোট করে দেখাতে চাইছি না, আমি বরং প্রতিটি নাগরিককে সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধানে যুক্ত হতে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের সাংগঠনিক ভূমিকাকে আরো কার্যকরী করার কথা বলছি। সরকারের সক্ষমতাকে শুধু এর রাজস্ব আদায় দিয়ে বিচার করা ঠিক হবে না। সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি তার জনগণ। জনগণকে সঠিকভাবে পরিচালিত ও উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে সরকার যা অর্জন করতে পারে, শুধু রাজস্ব দিয়ে তার ভগ্নাংশও সম্ভব নয়।
আমি সরকারের একটি নতুন ভূমিকার প্রস্তাব করছি, যেখানে সরকার সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে উপযুক্ত আইনি কাঠামো, নীতি ও প্রণোদনার মাধ্যমে পুরো জাতিকে সংগঠিত করবে।

প্রশ্ন : এই পরিবর্তনে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : জনগণকে পরিচালিত করার ক্ষমতা সরকারের আছে। যেকোনো রূপান্তর প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুততর হয় যদি সরকার উপযুক্ত নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরা নতুন গন্তব্যে পৌঁছাতে নতুন রাস্তা তৈরি নিয়ে কথা বলছি। সরকার যদি উৎসাহের সাথে এ কাজে যুক্ত হয়, তা হলে নতুন রাস্তা তৈরির কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এ প্রক্রিয়ার একটি মূল উপাদান হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। আমাদেরকে নতুন নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে হবে এবং এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রতিটি তরুণ এখন থেকে এটা ভাববে যে, তাকে আর চাকরির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না- সে চাইলেই একজন উদ্যোক্তা হতে পারে। সরকার নাগরিকদেরকে সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড, বিনিয়োগ তহবিল ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে তরুণরা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পায়। সরকার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে প্রথাগত ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে পারে, প্রণোদনা দিতে পারে।

সরকার সামাজিক ব্যবসাগুলোকে দরিদ্র মানুষদের ও দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত করতে পারে। একটি নিরবচ্ছিন্ন ও টেকসই রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে সরকারের অনেক কিছুই করার আছে।

প্রশ্ন : আপনি সব সময়ই বলে আসছেন যে, ব্যবসায় উদ্যোগ বেকারত্বের সমাধান করতে পারে। ব্রাজিলে ব্যবসায় উদ্যোগ বলতে কখনো কখনো অনানুষ্ঠানিক কাজকে বোঝানো হয়। যেমন- একজন ব্যক্তি যে চাকরি হারিয়েছে সে একজন অনানুষ্ঠানিক বিক্রেতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করল। মানুষ বলছে সে একজন উদ্যোক্তা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে একটি অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছে। এ অবস্থায় প্রকৃত ব্যবসায় উদ্যোগ কি আনুষ্ঠানিক খাতে যত চাকরি ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো প্রতিস্থাপন করতে পারবে? কিভাবে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : আমি ওই ব্যক্তিটির অনিশ্চিত অবস্থা বিষয়ে আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। তার অবস্থা অনিশ্চিত, কেননা সে তার ব্যবসাকে টেকসই করতে পারছে না। তার ওই ব্যবসা অর্থায়নের জন্য কোনো যথাযথ ব্যবস্থা নেই। তাকে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে। ব্যবসার জন্য প্রয়োজন অর্থায়ন; যা হচ্ছে ব্যবসার জ্বালানি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের দরকার বিশেষায়িত ব্যাংক, যেমন সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক। এ ধরনের ব্যাংক সব জায়গায় দরকার, বিশেষ করে দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে। মানুষ বাস করে এমন সব জায়গায়, এ ধরনের ব্যাংক থাকতে হবে। এগুলো মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে।

আপনার কাহিনীতে রাস্তার পাশে শার্ট বিক্রি শুরু করা যে লোকটির কথা বলছেন, সে হয়তো এখন দৈনিক পাঁচটি শার্ট বিক্রি করে; অথচ এর ১০ গুণ বেশি শার্ট বিক্রি করার দক্ষতা তার আছে। নিজের ব্যবসাকে বড় করার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি তার নেই। সে ব্যবসা ছেড়ে দিলো। একটি চাকরি জোগাড় করে নিলো। কিন্তু ব্যবসার পুঁজি থাকলে তার কাছে বিভিন্ন বিকল্প থাকত; সে চাকরি একেবারে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসাকে পুরোপুরি লেগে পড়তে পারত, অথবা চাকরির পাশাপাশি শার্ট বিক্রির ব্যবসাও চালিয়ে যেতে পারত, অথবা ব্যবসার কথা পুরোপুরি ভুলে গিয়ে চাকরি করতে পারত, অথবা ব্যবসায়ে আবারো ফিরে যেতে উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারত।

আমি বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে এটি পুরোপুরি ভুলিয়ে দেয় এবং বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, চাকরিই আমাদের একমাত্র পরিণতি।

প্রশ্ন : আপনি সবসময় আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স কর্তৃক আমাদের কাজ কেড়ে নেয়ার ঝুঁকির কথা বলে আসছেন। এই মহামারীর সময়ে ডিজিটাল রূপান্তরের পরিমাণ বেশ বেড়ে গেছে। আপনি কি মনে করেন প্রযুক্তি ও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সমাজের ক্ষতির করছে? এ সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান কী?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : যেকোনো প্রযুক্তিরই দুই ধরনের প্রয়োগ রয়েছে। এটি একটা আশীর্বাদ হতে পারে, আবার অভিশাপও হতে পারে। এটি নির্ভর করবে আমরা একে কোন দিকে পরিচালিত করছি, তার ওপর। এটি একই সাথে আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই হতে পারে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স মানব জাতির জন্য বিপুল কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আমি এর কল্যাণমূলক ব্যবহার সমর্থন করি। কিন্তু আমি তখনই এর বিরোধিতা করি, যখন এটি ব্যাপকভাবে মানুষের কাজ কেড়ে নেয়।

যখন কোনো নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি করা হয়, তখন আমাদেরকে অবশ্যই ঠিক করতে হবে এটি কোথায় ব্যবহার করা হবে, কোথায় এর প্রয়োগ সীমিত করতে হবে। ওষুধের উদ্ভব হয়েছে মানুষকে সুস্থ করতে; কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এমন রাসায়নিক তৈরি করা যায়, যা দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়।

আমার যুক্তি হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সকে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এটি বন্ধ করতে হবে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স অন্য সব প্রযুক্তির মতো নয়; এটি যে কেবল নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় এটি প্রতিবারই নিজের উন্নততর সংস্করণ তৈরি করতে পারে। এর কোনো সীমা নেই।

প্রশ্ন : উদ্যোক্তা সৃষ্টি ছাড়াও পৃথিবীর পুনর্বিন্যাসের জন্য আর কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : শুরুতেই আমাদেরকে ‘তিন শূন্য’র একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে- শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য দারিদ্র্যের লক্ষ্য অর্জনে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, আর শূন্য বেকারত্বের একটি পৃথিবী।

আমাদেরকে অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, এর জায়গায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে, গোমাংস-জাতীয় খাবার ত্যাগ করতে হবে, প্লাস্টিকের সামগ্রী বন্ধ করতে হবে, বৃক্ষরোপণ করতে এবং বনাঞ্চল সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করতে হবে, ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হবে; যাতে গৃহহীনরাও এর সুবিধা পেতে পারে, অল্প কিছু লোকে হাতে সব সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার সব পথ বন্ধ করতে হবে, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স কর্তৃক মানুষকে পৃথিবীর বুকে আবর্জনায় পরিণত করা থেকে রক্ষা করতে হবে, এবং এসব সমস্যার সমাধানকল্পে সামাজিক ব্যবসার পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।

প্রশ্ন : আমরা পৃথিবীর এই পুনর্বিন্যাসে ব্যর্থ হলে এই গ্রহের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : এরই মধ্যে মানবজাতি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি আমাদের এত দিনের অনুসৃত পথেই চলতে থাকি, তা হলে পৃথিবীর বুক থেকে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাবো। এটি শিগগিরই ঘটতে পারে, তবে তা নির্ভর করছে টিকে থাকার জন্য আমরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, তার ওপর।

প্রশ্ন : আপনি যুক্তি দেখিয়ে আসছেন যে, ক্ষুদ্রঋণ অসমতা হ্রাস করতে সহায়তা করে। একে কিভাবে আরো জোরদার করা যায়? সরকারের কি এ কাজ করা উচিত?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস : সরকারের উচিত হবে না কোনো ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করা, কেননা সরকার এ কাজ করতে গেলে প্রায় সাথে সাথেই এই কর্মসূচির রাজনীতিকরণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর ফলে এই কর্মসূচি একটি দাতব্য কর্মসূচিতে পরিণত হবে। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।

সরকারের উচিত হবে উপযুক্ত আইনি কাঠামো সৃষ্টি করে মানুষকে ‘সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক’ সৃষ্টির লাইসেন্স দেয়া যে ব্যাংকগুলোর সঞ্চয় সন্নিবেশ করার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। এই লাইসেন্স অবশ্যই ব্যক্তিগত মুনাফা-সন্ধানী ব্যাংক তৈরির জন্য দেয়া হবে না; এটি করা হলে এসব ব্যাংক শিগগিরই মহাজনী ব্যাংকে পরিণত হবে।


আরো সংবাদ



premium cement