২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দোষের কিছু নেই নৈশকালীন নির্গমণ বা স্বপ্নদোষে

দোষের কিছু নেই নৈশকালীন নির্গমণ বা স্বপ্নদোষে। - ছবি : সংগৃহীত

মানুষ মাত্রই যৌন জীবন নিয়ে অনুসন্ধিৎসু থাকে। বিষয়টি প্রকাশ করতে অনেকে লজ্জা পায় বা দ্বিধান্বিত থাকে। একজন সুস্থ স্বাভাবিক নারী শিশুর ৮ থেকে ১২ বা ১৩ বছরের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন হয় বা ঋতুশ্রাব শুরুর মাধ্যমে তার নারীত্ব প্রকাশ পায়, তেমনই একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ শিশুও আট থেকে নয় বছর বয়স থেকে তার শারীরিক পরিবর্তন যেমন- দাঁড়ি-গোঁফ গজিয়ে স্বপ্নের মাঝে কোনো এক রাতে বীর্যপাতের মাধ্যমে হঠাৎ সে বালেগ হয়ে যায়। এভাবে ঘুমের মাঝে অবচেতন অবস্থায় কোনো প্রকার সক্রিয় যৌন কার্যক্রম ছাড়াই অনিচ্ছাকৃত বীর্যপাতকে নৈশকালীন নির্গমণ বা স্বপ্নদোষ বলে। পুরুষ শিশুর এই প্রক্রিয়াটিকে ঘুমন্ত বা নিদ্রারত রাগমোচন বা নিদ্রারতি, যৌন স্বপ্ন, সিক্ত স্বপ্ন বা নৈশপতনসহ আরো কিছু নামে চিহ্নিত করা হলেও স্বপ্নদোষ নামেই বহুল পরিচিত। যেখানে পুরুষ বা ছেলেদের ক্ষেত্রে বীর্যপাত ঘটে এবং মহিলা বা মেয়েদের ক্ষেত্রে শুধু রাগমোচন বা সিক্ততা বা উভয় প্রক্রিয়াটিই ঘটে থাকে। বাংলায় শব্দটির নামে ‘দোষ’ থাকলেও এতে কিন্তু দোষের কিছু নেই। বরং বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এটি বয়ঃসন্ধি বা উঠতি তারুণ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল পার হওয়ার অনেক পরেও ঘটতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় যোনিপথ পিচ্ছিল থাকা সকল ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষের ঘটনা ঘটে না, এমনিতেই ঘটতে পারে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় স্বপ্নদোষ :
মানবসন্তান বিশেষত ছেলেরা, বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছালে তাদের বীর্যথলিতে বীর্য ও অণ্ডকোষে শুক্রাণু তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে বীর্য ক্রমাগত বীর্যথলিতে জমা হতে থাকে। বীর্যথলির ধারণক্ষমতা পূর্ণ হওয়াার পর নিদ্রারত অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত ঘটে দেহে বীর্যের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রিত হয়, একেই স্বপ্নদোষ বলে। স্বপ্নদোষের সময় অনেকে স্বপ্নে অবচেতনভাবে যৌন কর্মকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি অবলোকন করেন, তবে উক্ত অনুভূতি ছাড়াও স্বপ্নদোষ হতে পারে। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষে বীর্যপাতের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে। স্বপ্নদোষ নারীদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। মেয়েদের স্বপ্নদোষের ফলে সাধারণত বীর্য নির্গত হয় না, ফলে তা স্বপ্নদোষ কি-না তা সহজে চিহ্নিত করা যায় না।

স্বপ্নদোষের কারণ :
স্বপ্নদোষ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটি কোনো শারীরিক সমস্যা নয়। এটি প্রজননক্ষম জীব হিসেবে মানব প্রজাতির স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার একটি অংশ। বয়ঃসন্ধিকালে দেহের যৌন বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ধনের ফলাফলস্বরূপ এটি ঘটে থাকে। স্বপ্নদোষ সংগঠনের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে স্থান ও বয়সভেদে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কিছু পুরুষ দাবি করে, তারা যে সময়ে সঙ্গম অথবা কোনভাবেই যৌনকর্মে সক্রিয় হন না, কেবল তখনই এটি ঘটে থাকে। কিছু পুরুষ তাদের বয়ঃসন্ধিকালে বা উঠতি কৈশোরে বহুসংখ্যকবার স্বপ্নদোষের সম্মুখীন হয়েছে, আর কিছু পুরষের জীবনে এ প্রক্রিয়াটি একবারও ঘটেনি। যদিও বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো সমীক্ষা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৩ ভাগ পুরুষ জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বপ্নদোষের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। বয়ঃসন্ধিকালে যারা প্রথম স্বপ্নদোষের অভিজ্ঞতা লাভ করে, তারা অনেকেই প্রথমদিকে একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে, অজানা কারণে তারা আতঙ্ক ও হীনম্মন্যতা বোধ করেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বপ্নদোষের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে।

স্বপ্নদোষ বয়ঃসন্ধিকালে যৌন হরমোনের আধিক্যের কারণে হলেও তা অন্য কিছু কারণেও তা হতে পারে, যেমন :
- স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত যৌন বিষয়ক চিন্তা করা
- পর্ণোগ্রাফি বা নীল ছবিতে আসক্ত হওয়া
- যৌন উদ্দীপক বই পড়া
- শয়নকালের আগে যৌন বিষয়ক চিন্তা করা
- বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুর সাথে অডিও-ভিডিও চ্যাট করা হলে ঘুমে স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে।

অন্যদিকে বয়ঃসন্ধিকালে কারো কারো স্বপ্নদোষ নাও হতে পারে, এতে এটা প্রমাণ করে না যে তার সমস্যা আছে। আবার নিয়মিত হস্তমৈথুনের প্রভাবে স্বপ্নদোষের পরিমাণ হ্রাস পায়। স্বপ্নদোষের সাথে সবসময় স্বপ্ন দেখার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।

স্বপ্নে বীর্যপাতে কিছু করনীয় :
- এ সময় জেগে গেলে বীর্যপাত প্রতিরোধের চেষ্টা না করা ভালো। একবার বীর্যপাত প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে তা প্রতিরোধ করা যায় না। প্রতিরোধ করতে গেলে মুত্রনালীর ক্ষতি হতে পারে।
- বিষয়টা নিয়ে হীনমন্যতায় না ভোগে এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে নিয়মমত পরষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা।
- সপ্তাহে তিন-চার বার বা তার বেশি স্বপ্নদোষ হতেই পারে, এ নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক শারীরিক ব্যাপার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে ‘নরমাল ফিজিওলজিক্যাল’ ব্যাপার বলা হয়।
- স্বপ্নদোষের বীর্য ক্ষয়ে শরীর ক্ষয় বা স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার কোনো কারন নেই। এটা হলে শরীরের সকল ‘পুষ্টি’ বের হয়ে যাচ্ছে মনে করে অযথাই চিন্তা করারও কোনো কারণ নেই।
- একজন পুরুষ বালেগ হওয়ার সাথে সাথেই তার শরীরে বীর্য তৈরি হতে থাকে এবং এগুলো সেমিনাল ভেসিক্যাল বা বীর্যথলিতে জমা হয়ে বিভিন্নভাবে যেমন- যৌনসঙ্গম, স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বের হয়ে যেতেই হবে।

যেহেতু স্বাভাবিক নিয়মিত স্বপ্নদোষ কোনো সমস্যা নয়, তাই এর কোনো চিকিৎসাও নেই। তবে অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত স্বপ্নদোষের ব্যাপারে চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। জীবনের শুরুতে অস্বাভাবিক বীর্যপাতের কারণে অনেকেই লজ্জা, পাপবোধ ও অন্তর্দহনে ভোগতে পারে এবং এ বিষয়ে সু-পরামর্শ না পেলে এক সময় অপচিকিৎসার শিকার হয়ে ভবিষ্যতের বিভিন্ন যৌন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অথচ প্রায় সকল ধর্মেই ঘুমের মাঝে বীর্যপাত নিয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে অভিভাবকের সাথে আলাপ করে যথাযথ চিকিৎসকের (ইউরোলজিস্ট/ এন্ড্রোলজিস্ট) পরামর্শ নিয়ে চলা উচিত।

অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত স্বপ্নদোষের নিয়ন্ত্রণে কিছু পরামর্শ :
- স্বপ্নদোষের কারনগুলোকে এড়িয়ে চলা।
- বিবাহিত পুরুষেরা নিয়মিত সুস্থ যৌন জীবনে অভ্যস্ত হওয়া।
- পর্যাপ্ত পানি পান করা।
- কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত থাকা।
- ঘুমানোর আগে মলমুত্র ত্যাগ করে ঘুমানো।
- ঘুমানোর আগে ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার না করা।
- ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।

লেখক সহযোগী অধ্যাপক
এন্ড্রলজি ও ফিমেল ইউরোলজি ইউনিট
ইউরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement