২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হাইপারটেনশন ও হার্ট অ্যাটাক প্রতিকার ও প্রতিরোধ

হাইপারটেনশন ও হার্ট অ্যাটাক প্রতিকার ও প্রতিরোধ -


রক্ত হচ্ছে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে পুষ্টি সরবরাহকারী উপাদান। এটি শরীরের মধ্যে কিছু চিকন পাইপের মতো নালিকা দিয়ে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়, নালিকাগুলোকে রক্তনালী কিংবা ব্লাড ভেসেল বলা হয়। সবগুলো রক্তনালিকার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে হার্ট, হার্ট থেকে রক্তনালীসমূহ সারা শরীরে প্রবাহিত হয়। হার্টকে যদি আমরা একটি মোটর পাম্পের মতো কল্পনা করি, তাহলে রক্তনালীসমূহ হচ্ছে মোটর পাম্পের মুখে আটকানো ডেলিভারি পাইপের মতো। মোটর পাম্পের মুখে আটকানো ডেলিভারি পাইপ দিয়ে যেমন বাগানে পানি দেয়া হয়, তদ্রুপ হার্ট নামক পাম্প দিয়ে সারা শরিরে রক্ত সরবরাহ করা হয়, যেখানে হার্ট পাম্পিং মেশিন হিসাবে কাজ করে, রক্তনালীসমূহ ডেলিভারি পাইপের মতো কাজ করে। একজন মানুষের রক্তনালীসমূহ যদি পাশাপাশি রেখে জোড়া লাগানো হয়, তাহলে তা এক লাখ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে প্রায় ৫ লিটার ব্লাড থাকে এবং এই ৫ লিটার ব্লাড মাত্র এক মিনিটে হার্ট থেকে রক্তনালী হয়ে সারা শরীর ঘুরে আবার হার্টে আসে।
হার্টবিট
মোটর পাম্প যেমন বিদ্যুৎ দিয়ে চালু করলে তাতে কিছু ছোট চাকার ঘূর্ণনের ফলে পানি উঠে আসে, তেমনি হার্ট নামক পাম্পিং যন্ত্রটা প্রতি মিনিটে প্রায় গড়ে ৭৫ বার করে প্রকম্পিত হয়, তথা ৭৫ বার হার্ট অটোমেটিকভাবে সামনের দিকে ধাক্কা খায়, আবার পিছনে ফিরে আসে, অর্থাৎ একবার সঙ্কুচিত হয়, আরেকবার সম্প্রসারিত হয়, যাকে হার্টবিট বলে। এই ধাক্কার ফলে হার্টের ভিতরের রক্তসমূহ রক্তনালীতে প্রবেশ করে, আবার অন্য রক্তনালী দিয়ে হার্টে ফিরে এসে।
ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ
হার্ট থেকে রক্তসমূহ যখন রক্তনালীতে আসে, তখন রক্তনালীতে চলাচলের সময় ব্লাডগুলো রক্তনালীর গায়ে এক ধরনের চাপ তথা প্রেশার প্রয়োগ করে, একেই ব্লাড প্রেশার বলা হয়। যেমন মোটর পাম্প থেকে পানি যখন ডেলিভারি পাইপে আসে, তখন পাইপগুলো আমরা হাতে নিলে পানির একটি প্রেশার পাই, ঠিক তদ্রুপ রক্তনালীতে রক্তসমূহ একটি প্রেশার প্রয়োগ করে তাকে ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ বলা হয়।
একটি মোটর পাম্প যদি পর্যাপ্ত ইলেকট্রিসিটি পেয়ে একই সমান্তরালভাবে চলতে থাকে এবং ডেলিভারি পাইপ যদি পরিষ্কার থাকে, কোথাও যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহলে পানির পাম্পিং আর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে, ঠিক তদ্রুপ হার্ট যদি সুস্থ থাকে, আর রক্তনালীসমূহে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। রক্ত চলাচল করতে বাড়তি প্রেশার লাগবে না।
হাইপ্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ
তবে রক্তনালীসমূহ যদি ক্লিয়ার না থাকে, তথা সেখানে যদি চর্বি (কোলেস্টেরল) জমা হয়, কিংবা হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে রক্তনালীতে রক্তসমূহ চলাচলের সময় একটি বাড়তি প্রেশার অনুভব করবে, যেমন মনে করি, হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা মিনিটে ৫ লিটার ব্লাড, এখন যদি বডিতে ব্লাড আর অতিরিক্ত ফ্লুইড যদি জমা হয়ে যায়, তাহলে বেশি ফ্লুইড একই সময়ে রক্তনালীতে স্বাভাবিকভাবে পরিবাহিত হবার কিংবা রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে এবং রক্ত সঠিক পরিবহনের জন্য একটি বাড়তি প্রেশার লাগবে, যাকে হাইপ্রেশার কিংবা উচ্চচাপ বলা হয়। রক্তের এই প্রেশারগুলো প্রেশার পরিমাপক যন্ত্র তথা স্পিগনোম্যানোমিটার (প্রেশার মাপার মেশিন) দিয়ে পরিমাপ করা হয়। হার্ট সঙ্কোচনের (systole) সময় স্বাভাবিক প্রেশার থাকে ১০০-১২০ mmHg আর হার্টের সম্প্রসারণের সময় স্বাভাবিক প্রেশার থাকে ৬০-৯০ mmHg. এখন কারো ক্ষেত্রে যদি এই প্রেশারে তারতম্য ঘটে, তথা প্রেশার যদি ১৪০-৯০ এর উপরে চলে যায়, তাহলে এটাকে হাইপ্রেশার বলা হয়, যার অপর নাম হচ্ছে হাইপারটেনশন।

হাইপ্রেশারের কারণসমূহ
১. ঙষম ধমব বা বয়স্কদের হাইপ্রেশারের চান্স বেশি, কারণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে রক্তনালীগুলো গাঢ় কিংবা শক্ত হতে থাকে, তাই সেই নালিকা দিয়ে রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক চাপ বেড়ে যায়, যাকে হাইপ্রেশার বলে।
২. মহিলাদের তুলনার পুরুষদের রক্তচাপ বেশি থাকে।
৩. জেনেটিক তথা ফেমিলিগত কারণে অনেকের হাইপ্রেশার থাকে, তাদের হার্টের আউটপুট বেশি থাকে, এবং হাইপ্রেশার হয়। বয়স, লিঙ্গ, বংশগত (Age, sex and Genetic) এই তিনটা কারণের মধ্যে আমাদের কোনো হাত থাকে না, কিংবা আমরা চাইলেও এটি পরিবর্তন করতে পারি না, এ জন্য এই তিনটি কারণকে Non Modifiable Risk factor for Hypertension বলে।
হাইপারটেনশনের আরো কিছু কারণ আছে, যাকে ইচ্ছা করলে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাকে Modifiable risk factor for Hypertension বলে।
নিম্নে একটা তালিকা দেয়া হলো, এসব কারণে যদিও হাইপ্রেশার হয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব :
১. ধূমপান, কারণ হচ্ছে সিগারেট এর মধ্যে নিকোটিন নামক এক প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা LDL cholesterol নামক একপ্রকার চর্বিকে রক্তনালীতে আটকিয়ে রাখে, এতে করে রক্তনালীসমূহ সরু হয়ে যায়, শক্ত হয়ে যায়, ইলাস্টিসিটি কমে যায় এবং রক্ত সঞ্চালনে বাধাগ্রস্ত হয়, যার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
২. অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ যথা, গরুর গোশত, খাশি, হাঁস, তৈলাক্ত খাবার এবং ডিম ইত্যাদি। এতে করে রক্তে কোলেস্টেরল কিংবা চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং তা রক্তনালীর গায়ে জমা হয়ে রক্তনালী সরু হয় এবং রক্ত সঞ্চালনে বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. অ্যালকোহল গ্রহণ
৫. মানসিক চাপ
৬. অতিরিক্ত শারীরিক ওজন
৭. বংশগত কারণ
৮. বয়স (৫৫ বছর পুরুষ) (৪০ মহিলা)
৯. তামাক, জর্দা, চুন
১০. খাবারে অতিরিক্ত লবণ
১১. কিছু হরমোনাল কারণ
১২. কিডনি রোগ
১৩. হাইপারথাইরয়েডিযম
১৪. কুশিং সিন্ড্রোম
১৫. অ্যাথারোসক্লেরোসিস ডিজঅর্ডার

হাইপারটেনশনের প্রকারভেদ উপসর্গ জটিলতা, প্রতিকার
উপরে আমরা জেনেছি, যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ mmHg এর বেশি হয়, তবে তাকে হাই ব্লাড প্রেশার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। হাইপ্রেশার বা হাইপারটেনশনকে আবার তিনটি গ্রেডে ভাগ করা হয়, যথা গ্রেড-১, যদি সিস্টোলিক প্রেশার ১৪০-১৫৯ mmhg আর ডায়াস্টোলিক প্রেশার যদি ৯০-৯৯ mmHg হয়, তবে এটি গ্রেড ১ হাইপারটেনশন, যাকে মাইল্ড হাইপারটেনশনও বলা হয়।

গ্রেড-২ বা মডারেট হাইপারটেনশন
১৬০-১৭৯/ ১০০-১০৯ যদি সিস্টোলিক প্রেশার ১৬০-১৭৯ সসযম আর ডায়াস্টোলিক প্রেশার যদি ১০০-১০৯ সসঐম হয়, তবে এটিকে গ্রেড-২ হাইপারটেনশন বা মডারেট হাইপারটেনশন বলে।
গ্রেড-৩ সিভিয়ার হাইপারটেনশন : যদি সিস্টোলিক বা ডায়াস্টোলিক ১৮০-১১০ এর উপরে হয়, তবে তাকে সিভিয়ার হাইপারটেনশন বলে, এইটিকে হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিসও বলে। ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশন বা হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি নামেও চিহ্নিত করা হয়। এই প্রকার হাইপারটেনশন খুবই খারাপ, দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপ্রেশারের উপসর্গ
১। মাথা ব্যথা
২। ঘাড় ব্যথা, সাধারণত বাম পাশে বাম বাহু থেকে উপরের দিকে ঘাড়ে ব্যথা করবে।
৩। চোখে ঝাপসা দেখা।
৪। বুকে ব্যথা, যাকে অ্যানজাইনা বলে।
৫। মাথা ঘোরানো।
৬। নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
৭। শ্বাসকষ্ট হওয়া।
৮। বুক ধড়ফড় করা।
৯। অবসাদ লাগা।
১০। ঘুম কম হওয়া।

জটিলতা
হাইপ্রেশার এর সবচেয়ে বড় জটিলতা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক এবং ব্রেইন স্ট্রোক, প্রায় প্রতি বছর গ্লোবাল ডেথ-এর ৩৩% হার্ট অ্যাটাক কিংবা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যায়, যাদের অনেকেই Undiagnosed থাকে, তাদের যে হাইপ্রেশার ছিল, তাও তাদের জানা থাকে না, তাই দেখা যায়, হঠাৎ করে বুকে ব্যথা উঠে পড়ে যায় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারেন।

অন্যান্য জটিলতা
১। বুকে অসহনীয় ব্যথা বা unstable angina
২। ক্রনিক কিডনি ডিজিজ
৩। ভাস্কুলার ডিজিজ ইত্যাদি।
প্রতিরোধ
১। ধূমপান থেকে বিরত থাকা।
২। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার থেকে বিশেষ করে গরুর গোশত খাবার থেকে বিরত থাকা
৩। লবণ কম খাওয়া
৪। BMI ২৪ এর মধ্যে রাখা তথা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৫। নিয়মিত ব্যায়াম করা
৬। প্রচুর শাকসবজি খাওয়া বা ফাইবার খাওয়া
৭। কাঁচা ফলমূল খাওয়া।
৮। ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
লেখক : ফ্যামিলি মেডিসিন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ। মোবাইল ০১৬৮৪৯৩৬০৬৭
rifat3265all@gmail.com

চেম্বার : র‌্যামফিট মেডিক্যাল কনসাল্টেশন সেন্টার,২১৭ আউটার সার্কুলার রোড, মগবাজার, ঢাকা।

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement