২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মস্তিষ্কের রক্তনালীর এনজিওগ্রাম

-

হার্টের এনজিওগ্রাম হয় আমরা সবাই জানি। খুব পরিচিতও। পরিবার বা চেনাজানাদের মধ্যে হার্টের এনজিওগ্রাম হয়নি এমন কিন্তু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ব্রেনের এনজিওগ্রামের সাথে খুব কম মানুষই পরিচিত। অনেকে মনে করেন ব্রেনের এনজিওগ্রাম হয় হয়তো বা তবে তা বিদেশে। না, ব্রেনেরও এনজিওগ্রাম হয় এবং আমাদের দেশেই হয়। ব্রেনের এনজিওগ্রামকে বলা হয় ডিএসএ বা ডিজিটাল সাবট্রাকশন এনজিওগ্রাম।
ব্রেনের এনজিওগ্রাম
মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গে রক্তনালীর মাধ্যমে রক্ত চলাচল করে। এ রক্তনালীতে দেখা দেয় নানান অসুখ। হার্টের রক্তনালীতে ব্লক হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়। দেখা দেয় হার্ট অ্যাটাক। ব্রেনের রক্তনালীর রোগ কিন্তু বৈচিত্র্যময়। কখনো রক্তনালী বন্ধ হয় আবার কখনো ফেটে যায়। কখনো আবার রক্তনালী নিজেদের মধ্যে অস্বাভাবিক কানেকশন তৈরি করে। একেক রোগের চিকিৎসা একেক রকম। ব্রেনের রক্তনালী ব্লক হয়ে গেলে যে স্ট্রোক হয় তাকে বলে ইস্কেমিক স্ট্রোক। আবার ফেটে গেলে যে সমস্যা হয় তাকে বলে হেমোরেজিক স্ট্রোক। দুটোই মারাত্মক। স্ট্রোক যে মারাত্মক ভয়াবহ রোগ তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী যত মানুষ মারা যান তার দ্বিতীয় কারণ স্ট্রোক।
ব্রেনের এসব রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করে চিকিৎসা দিতে প্রয়োজন পড়ে ব্রেনের এনজিওগ্রামের।
পদ্ধতি
হার্টের এনজিওগ্রাম যেভাবে করা হয় ব্রেনের এনজিওগ্রাম ঠিক একইভাবে করা হয়। তবে পদ্ধতিগতভাবে কিছু পার্থক্য আছে।
ব্রেনের এনজিওগ্রাম করার জন্য প্রয়োজন পড়ে ক্যাথল্যাবের। যেমনটি প্রয়োজন হয় হার্টের এনজিওগ্রামের জন্য। এনজিওগ্রাম করার আগে রোগী পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত কিনা তা যাচাইয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো সমস্যা না থাকলে রোগীকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগীর কুচকিতে ক্যানুলার মতো সিথ পড়িয়ে দেয়া হয়। এটিই মূল অংশ। এ কাজে রোগী কিছুটা ব্যথা পেতে পারেন। তবে তা হাতে ক্যানুলা পড়ানোর মতোই। এরপর নিউরোইন্টারভেনশনিস্ট ওয়ার-ক্যাথেটারের মাধ্যমে ব্রেনে ডাই দিয়ে ছবি তুলেন। খুব বেশি সময় লাগে না। মিনিট তিরিশেক সময় লাগে।
কেন করা হয়?
মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম করা হয় দুটো উদ্দেশ্যে- ১. রোগ নির্ণয় ও ২. মস্তিষ্কের রক্তনালীর চিকিৎসায়।
রোগ নির্ণয়
মস্তিষ্কের রক্তনালীতে বেশ কিছু রোগ হয়। যেমন- স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্তনালীর রোগ। রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে দেখা দেয় ইস্কেমিক স্ট্রোক। আমাদের ঘাড়ে থেকে চারটি রক্তনালী মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে। এদের কোনোটির গোড়ায় ব্লক হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। হার্টের রক্তনালীর মতো স্ট্যান্ট যেটিকে অনেকেই রিং বলে থাকেন তা লাগানো লাগতে পারে। রক্তনালীর ব্লক ধরতে প্রয়োজন ডিএসএর।
মস্তিষ্কের রক্তনালীতে ফোস্কার মতো ফুলে যেতে পারে। যেটিকে বলে এনিউরিজম। এনিউরিজম ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ ধরনের রক্তক্ষরণকে বলে সাব এরাকনয়েড হেমোরেজ। এ ক্ষেত্রে এনিউরিজম আছে কিনা তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে প্রয়োজন হয় ডিএসএ।
রক্তনালীর জটলা পাকিয়ে যেতে পারে। একে বলে আর্টেরিও ভেনাস ফিস্টুলা বা এভিএম। জটলা পাকানো রক্তনালী ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এভিএম নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন ডিএসএ পরীক্ষা।
মস্তিষ্কের মূল রক্তনালীগুলো শুকিয়ে যেতে পারে। মূল রক্তনালীর কাজ করার জন্য নতুন নতুন ছোট ছোট চিকন রক্তনালী তৈরি হতে পারে। একে বলে ময়াময়া রোগ। এটি নিশ্চিত হতে প্রয়োজন পড়ে ডিএসএর।
অনেকের আবার আঘাতের কারণে দুটো রক্তনালীতে অস্বাভাবিক কানেকশন বা সংযোগ হতে পারে। একে বলে ক্যারোটিড ক্যাভারনাস ফিস্টুলা বা সিসিএফ। এটি নির্ণয় করতে প্রয়োজন ডিএসএর।
রক্তনালীর রোগের চিকিৎসা
রক্তনালীর রোগ নির্ণয় করতে যেমন প্রয়োজন মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম। তেমনি ক্যাথল্যাবে এনজিওগ্রাম মেশিনের সাহায্যে মাথা না কেটে অত্যাধুনিক চিকিৎসাও করা যায়।
কয়েল নামক একধরনের আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে রক্তনালীর ফোস্কা বা এনিউরিজম বন্ধ করা যায়। এটিকে বলে কয়েল এম্বোলাইজেশন। এটি ক্যাথল্যাবে করা হয়। এ ছাড়া গ্লু এম্বোলাইজেশনের মাধ্যমে এভিএম ও সিসিএফের চিকিৎসা মাথা না কেটেই করা যায়।
স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি। স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্ট্রোক আক্রান্ত ব্যক্তি ছয় ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আসলে তাকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে ডিএসএ করা হয়। এরপর ক্যাথেটার ও তারজালির মতো স্ট্যান্টের সাহায্যে জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড বের করে আনা হয়। ফলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়।
কিছু কিছু অপারেশনের আগে টিউমারে রক্ত চলাচল কমানো সম্ভব হয়। ফলে অপারেশনে রক্তক্ষরণ কম হয়। সময়ও কম লাগে।
মস্তিষ্কের রক্তনালীতে ব্লক থাকলে তা দূর করার জন্য রক্তনালীতে স্ট্যান্ট বসানো যায়।
দেশে ব্রেনের এনজিওগ্রাম
আমাদের দেশে স্ট্রোকের যত আধুনিক চিকিৎসা তা হয়। সরকারিভাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে (নিনস) অত্যাধুনিক দু’টি ক্যাথল্যাব মেশিন আছে। এখানে সব ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। এ হাসপাতালে এত বেশি পরিমাণে কাজ হয় যা বিশ্বের নামকরা হাসপাতালের চেয়ে কম নয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও ডিএসএ ও এর মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়। বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ধানমন্ডি ল্যাব এইড ডায়াগনোস্টিক, কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও এএমজেড হাসপাতালে ব্রেনের এনজিওগ্রাম করার ব্যবস্থা আছে।
লেখক : নিউরোলজিস্ট, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement