০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`
আন্তর্জাতিক এপিলেপ্সি দিবস

মৃগীরোগ চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণ হয়

-

মৃগীরোগ নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ নেই। জিন-ভূতের আছড় থেকে কত ধরনের কুসংস্কার যে আছে তার ইয়ত্তা নেই। মৃগীরোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক এপিলেপ্সি দিবস। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো এ দিবসটি।
মৃগীরোগ একটি মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের কিছু নিউরন বা স্নায়ুকোষে অস্বাভাবিক আচরণ করে। এ অস্বাভাবিক আচরণ পাশের কিছু নিউরনে ছড়িয়ে পড়ে। নিউরনের এ অস্বাভাবিকতার কারণে শরীরে বিভিন্ন রকম উপসর্গ দেখা দেয়। মৃগীরোগ কিন্তু এ উপসর্গগুলোর সমষ্টি।
মৃগীরোগকে আলোচনার সুবিধার্থে দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রাইমারি এপিলেপ্সি ও সেকেন্ডারি এপিলেপ্সি। চিকিৎসা ও লক্ষণগত পার্থক্যের কারণে এ বিভাজন।
প্রাইমারি এপিলেপ্সির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণত পাঁচ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এটি দেখা দেয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৩০ বছরের মধ্যে। পরিবারে অন্য কারো এ রোগের ইতিহাস থাকতে পারে। এ খিঁচুনি শুরু হয় পুরো শরীরজুড়ে। খিঁচুনির সময় মাথা সাধারণত মাঝামাঝি থাকে। সেকেন্ডারি এপিলেপ্সি সাধারণত পাঁচ বছরের কম ও ৫০ বছরের বেশি বয়সে হয়ে থাকে। সাধারণত মস্তিষ্কের টিউমার, স্ট্রোক, মাথায় আঘাতের পর এটি দেখা দেয়। শিশুর জন্মের সময় মাথায় আঘাত পেলে বা দেরিতে কান্না থেকেও হতে পারে এটি। এ খিঁচুনি শুরু হয় শরীরের কোনো অঙ্গ বা এক পাশ থেকে। মাথা যেকোনো একদিকে কাত করা থাকে। আক্রান্তরা খিঁচুনি শুরুর আগে বুঝতে পারেন খিঁছুনি হতে যাচ্ছে। যেটাকে বলে অরা।
মৃগীরোগের কারণ
প্রাইমারি মৃগীরোগের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না তা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক কারণে খিঁচুনি হতে পারে। মাথায় রক্তক্ষরণ হলে হতে পারে খিঁচুনি। এ ছাড়া মস্তিষ্কে ইনফেকশন, প্রদাহ, টিউমার, মাথায় আঘাতে হতে পারে খিঁচুনি। মেটাবলিক কারণ যেমন রক্তে সুগারের পরিমাণ অতিরিক্ত কমে গেলে বা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে, প্যারাথাইরয়েড হরমোন কমে গেলে, থাইরয়েড হরমোন অতিরিক্ত কমে মেক্সিডিমা বা অতিরিক্ত বেড়ে থাইরোটক্সিকোসিস ক্রাইসিস হলেও খিঁচুনি হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন অঙ্গের বিকল যেমন- কিডনি, লিভার ইত্যাদি বিকল হলে হতে পারে খিঁচুনি।
মৃগীরোগ নির্ণয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলো নিউরোইমেজিং। এমআরআই অব ব্রেন পরীক্ষা করলে খিঁচুনির অনেক কারণ বোঝা যায়। তবে সিটিস্ক্যান করলেও কিছু কারণ ধরা পড়ে। মস্তিষ্কের ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাম বা ইইজি পরীক্ষা করে খিঁচুনির ধরন সম্পর্কে বোঝা যায়। এ ছাড়া আরো অনেক পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। একজন নিউরোলজিস্ট মৃগীরোগের ধরন দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন কী ধররের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন।
খিঁচুনির ওষুধ সেবন কতদিন
খিঁচুনির বা এপিলেপ্সি একটি মারাত্মক রোগ। পরিবারে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হলেই বোঝা যায় এর ভয়াবহতা। খিঁচুনি ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কত দিন ওষুধ খেতে হবে তা জানেন না কেউ। এ জন্য বিরক্ত হয়ে অনেকে ওষুধ সেবন ছেড়ে দেন। সেবন বন্ধ করে দেখেন রোগ সেরে গেছে কিনা। দুটোই কিন্তু ক্ষতিকর।
প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি এপিলেপ্সি, দুটোর চিকিৎসা ভিন্ন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখবেন আপনি কোন ধরনের এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত। প্রাইমারি এপিলেপ্সি চিকিৎসায় সাধারণত ভালো হয়। চিকিৎসক যদি মনে করেন আপনি প্রাইমারি এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত তাহলে সোডিয়াম ভ্যালপ্রোয়েট, লিমোট্রিজিন, ফেনিটয়িন বা ফেরিবারবিটন জাতীয় ওষুধ সেবন করতে দেবেন। এ ওষুধগুলো স্বল্প মাত্রায় শুরু করে ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হয়। তাই চিকিৎসক ঘন ঘন পরিবর্তন করবেন না। মনে রাখবেন এটি এমন ধরনের অসুখ যা কোনো চিকিৎসকই জাদু করে সারাতে পারবেন না। তাবে ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা ঠিক করে দেয়ার পর নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে থাকেন। অনেকে আছেন কোনো চিকিৎসককে দেখানোর পর যদি খিঁচুনি হয় তাহলে আবার চিকিৎসক পরিবর্তন করেন। এটি ভুল। কারণ ওষুধ যদি শুরুতেই বেশি মাত্রায় দেয়া হয় তাহলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই ধীরে ধীরে ওষুধ বাড়ানোই শ্রেয়। ধৈর্য ধরে আপনার চিকিৎসকের সাথে থাকুন। অনেক সময় এক ওষুধে কাজ না করলে অন্য প্রকারের ওষুধ যোগ করতে হয়। আপনি নিয়মিত চিকিৎসক বদলাতে থাকলে কিন্তু তা সম্ভব হবে না। প্রাইমারিতে সাধারণত এক ধরনের ওষুধ দিয়েই খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডোজও কম লাগে। প্রাইমারি খিঁচুনির সুবিধা হলো- যদি অনেকদিন ধরে খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে আস্তে আস্তে ওষুধ কমানো যায় এবং এক সময় ওষুধ বন্ধও করা যায়। সাধারণত পাঁচ-সাত বছর সময় লাগতে পারে। কিন্তু নিজে থেকে ওষুধ বন্ধ করবেন না। হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করলে জীবননাশের কারণ হতে পারে। ওষুধ বন্ধ করার পর খিঁচুনি হলে আবার ওষুধ শুরু করতে হবে।
সেকেন্ডারি এপিলেপ্সিতে ওষুধ কিন্তু আজীবন সেবন করতে হবে। কোন কারণে খিঁচুনি হচ্ছে তার চিকিৎসা করতে হবে। যদি টিউমারের জন্য হয় তাহলে অপারেশন করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি যদি সেকেন্ডারি এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হন তাহলে যতদিন বেঁচে থাকবেন ওষুধ সেবন করে যাবেন। ওষুধ সেবন নিয়ে হতশায় ভুগবেন না। ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপে আক্রান্তরা তো আজীবনই ওসুধ সেবন করে যান।
নিজে থেকে খিঁচুনির ওষুধ বাড়াবেন না বা কমাবেন না। বন্ধ বা চালু করবেন না। পুরো দায়িত্ব দিন আপনার চিকিৎসকের হাতে।
মৃগীরোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। নিউরোলজিস্ট যখন কাউকে বলেন আপনার প্রিয়জন মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়েছেন তখন পরিবারের সবাই ভয়ে কুঁকড়ে যান। অনেকে আছেন শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। তারা ভাবেন মৃগীরোগ হলে কেউ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। এটি খুবই ভুল ধারণা।
মৃগীরোগ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো সমস্যা করে না। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম শুনেছেন। তার মতো দিগি¦জয়ী যোদ্ধা কিন্তু কমেই জন্মেছে এ জগতে। তিনি ছিলেন মৃগীরোগে আক্রান্ত।
সক্রেটিসের নাম শোনেননি এমন লোক কি আছেন? তার মতো দার্শনিক তো কমই আছে। তিনি কিন্তু মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন। সবচেয়ে অবাক হবেন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কিন্তু মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন। শুধু এরাই না আরো কত বিখ্যাত ব্যক্তি যে মৃগীরোগী ছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। এরা যদি মৃগীরোগ নিয়ে বিশ্বজয় করতে পারেন, বিশ্ববরেণ্য হতে পারেন তাহলে আপনার শিশু বা প্রিয়জন কেন নয়?
মৃগীরোগে আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিক স্কুলেই পড়তে পারে। স্বাভাবিক অন্য শিশুদের মতোই খেলাধুলা করতে পারে। তবে সাবধান হতে হবে, মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত পানিতে সাঁতার কাটা, নদী-পুকুরে নামা, আগুনের কাছে যাওয়া, ধারালো বস্তু নিয়ে কাজ করা, গাড়ি ড্রাইভিং করা এবং একাকী রাস্তা পারাপার হওয়া যাবে না। রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক সব কিছুই করা সম্ভব।
মৃগীরোগ কি ছোঁয়াচে
ছোঁয়াচে হলো সেই রোগ যা জীবাণুবাহিত। যেমন কোভিড ভাইরাসবাহিত রোগ। তাই এটি ছোঁয়াচে। কিন্তু মৃগীরোগ কোনো জীবাণুবাহিত না। এটি ব্রেনের নিউরনের অস্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। তাই এটি ছোঁয়াচে হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অনেকে ছোঁয়াচে মনে করে মৃগীরোগে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকেন। অনেকে আবার মৃগীরোগ আক্রান্তদের বাজে কথা বলতেও ছাড়েন না। এটি খুবই অমানবিক, জঘন্য ও ঘৃণ্য কাজ। একবার চিন্তা করুন আপনি নিজে বা আপনার প্রিয়জন কেউ মৃগীরোগে আক্রান্ত হলে এমন আচরণ করতে পারতেন; বরং মৃগীরোগে আক্রান্তদের সাথে সহনশীল আচরণ করুন। তারা সমাজের বোঝা নয়।
ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement