২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বন্ধ্যত্ব থেকে হোক মুক্তি

-

বন্ধ্যত্ব বা বাচ্চা না হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা। যদিও এই সমস্যার কারণে কারো শারীরিক ক্ষতি বা মৃত্যুবরণ করার সরাসরি কোনো সম্ভাবনা নেই তবুও ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন যে, বিষয়টি কতই না যন্ত্রণাদায়ক। একটি শিশুর মা অথবা বাবা হওয়ার বাসনা কার না আছে। বিয়ের আর যত উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন সন্তানের পিতা-মাতা হওয়া এর একটি প্রধান লক্ষ্য। বন্ধ্যত্বকে অনেকেই একটি অভিশাপ হিসেবে গণ্য করে থাকে আর এ জন্যই বন্ধ্যত্ব মোচনের জন্য অনেকেই সর্বস্ব ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না। যদিও গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, বিষয়টিকে আরো হালকা করে চিন্তা করা সম্ভব। যা হোক বাস্তব চিত্র হলো, শত শত সন্তানহীন দ¤পতি সন্তানলাভের আশায় চিকিৎসাসহায়তার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়। সামর্থ্যবানরা এ জন্য বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে আগ্রহী হন। এ জন্য প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যায়। অনেকেই অজ্ঞতার বশে পীর ফকির, ওঝা, জ্যোতিষ ও আরো নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শরণাপন্ন হয়ে বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে থাকেন। সন্তানহীন স্বামী-স্ত্রীর অজ্ঞতা ও মানসিক দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে অনেক প্রতারণার কথা প্রায়ই শোনা যায়।
আমাদের দেশের প্রচলিত ধ্যানধারণা ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সন্তানহীন নারী-পুরুষরা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর থাকেন বলেই বন্ধ্যত্বকে ঘিরে নানারকম সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনাচার গড়ে উঠেছে। অন্যান্য রোগের চিকিৎসার মতো বন্ধ্যত্বের চিকিৎসাও সবসময় শতকরা একশ ভাগ কার্যকর নয়। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে শতকরা প্রায় আশি-নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের একটি বিজ্ঞানসম্মত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর চিকিৎসাসহায়তা প্রদান করাও সম্ভব হয়। এ জন্য রোগী বা ভুক্তভোগীদের কিছু প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
কোনো সক্ষম দম্পতি এক বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে চেষ্টা করেও সন্তানলাভে ব্যর্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। সাধারণত দুই বছর কোনো প্রকার জন্মনিরোধক ব্যতিরেকে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করলে শতকরা নব্বই ভাগ দম্পতি সন্তানলাভে সমর্থ হয়।
বাচ্চা না হওয়ার বা দেরিতে হওয়ার কারণ বহুবিধ। কারণগুলোর প্রায় অর্ধেক ছেলেদের সমস্যা এবং বাকি অর্ধেক মেয়েদের সমস্যা। একই সাথে উভয়ের সমস্যাও দেখা যায়। অথচ বাচ্চা না হওয়ার কারণ হিসাবে অধিকাংশ সময়ে মেয়েদেরই ঢালাওভাবে দায়ী করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যখন কোনো দম্পতিকে বন্ধ্যত্বের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তখন পুরুষদের পরীক্ষাই আগে করানো যুক্তিসঙ্গত এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাই করে থাকেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায়ই নিয়মানুযায়ী করা হয় না।
বন্ধ্যত্বের অনেক কারণ আছে যেগুলো কোনো না কোনো হরমোনজনিত রোগের জন্য হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের দেশে হরমোনজনিত রোগের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসাব্যবস্থা হালনাগাদ শুরু হয়েছে এবং চিকিৎসাপেশার সাথে জড়িত অনেকেই এ ব্যাপারে ভালোভাবে অবহিত নন, কাজেই হরমোনজনিত রোগের কারণে বন্ধ্যত্বের বিষয়টি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। হরমোনজনিত কারণে মহিলাদের বন্ধ্যত্ব হলে সাধারণত তাদের মাসিক অনিয়মিত হয়, যৌবনপ্রাপ্তি স্বাভাবিকভাবে বা স্বাভাবিক সময়ে হয় না, অনেক সময় এসব মহিলার মুখে গোঁফ দাড়ির মতো চুল গজাতে পারে এবং থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত হলে সেই রোগের লক্ষণ দেখা যায়। বন্ধ্যত্বের অন্য কারণগুলোর বেশির ভাগই শরীরের গঠনতান্ত্রিক সমস্যার জন্য হয়ে থাকে এবং কোনো অভিজ্ঞ স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ বা ইউরোলজিস্টরাই তা ভালোভাবে বুঝতে বা চিকিৎসা করতে পারেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় প্রায়ই একাধিক বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ের অভাব অনেক সময় চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে কিছুটা ব্যাহত করে। তা মোটেই অভিপ্রেত নয়। যেহেতু চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই অতি প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের ঘাটতি একটি বাস্তব সমস্যা কাজেই এটি দূরীভূত করতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। হরমোনজনিত কারণে বন্ধ্যত্বের একটি বৈশিষ্ট্য হলো- এর চিকিৎসা খুবই ফলপ্রদ ও রোগ নির্ণয়ও বেশ সঠিক হয়।
বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় রোগী এবং চিকিৎসক উভয়কেই ধৈর্যধারণ ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। রাতারাতি সমস্যার সমাধান হবে এমনটি আশা করা যায় না। সহসাই ব্যয়বহুল কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেয়ে অনেক সময় ধৈর্যধারণ করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যেসব দম্পতি টেস্টটিউব বেবীর জন্য অপেক্ষমাণ থাকে তাদের প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ অপেক্ষাকালীন সময়েই কোনোরূপ চিকিৎসা ছাড়াই গর্ভবতী হয়ে থাকেন। কাজেই বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় যুক্তিসঙ্গতভাবে অপেক্ষা করাও অনেক সময় চিকিৎসার পর্যায়েই পড়ে। তবে অবশ্যই কোনো বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থেকেই তা করতে হবে।
লেখক : ডায়াবেটিস ও হরমোনজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ


আরো সংবাদ



premium cement