২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

কৈশোরে আত্মহত্যা

কৈশোরে আত্মহত্যা -

কোভিড-১৯, দুর্ঘটনা কিংবা শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণে মৃত্যু হয়, সেই চেয়ে আত্মহত্যায় মৃত্যু নিয়ে আমরা কতটা ভাবছি? সারা পৃথিবীতেই হু হু করছে বাড়ছে আত্মহননের হার। কৈশোর ও উঠতি যৌবনে এ সংখ্যাটা আরো বেশি। বয়ঃসন্ধিকালের হরমোনের ওলটপালট ঝড়ে মন থাকে বিক্ষিপ্ত। এই সময়ে যদি সামনে কোনো পরম সহায়, আদর্শ, অবলম্বন, অর্থনৈতিক আর সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকে, ভুল পথে পা চলে যায় যেকোনো সময়।
গত দুই দশকের খবর বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধর্ষণসহ শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতন, উত্ত্যক্ত করা বেড়ে গেছে বহুগুণে। হালে যোগ হয়েছে মুঠোফোনে ছবি, ভিডিও ধারণ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার বিকৃত মানসিকতা। নেশার উপাদান ঢুকে পড়ছে ঘরে ঘরে। মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য এত সহজলভ্য কোনোকালেই ছিল না। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এসবই কৈশোরকালীন আত্মহত্যায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়া এই বয়সে আত্মহত্যার আরেকটি কারণ। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনেক আগেই হারিয়ে এখন শুধুই সার্টিফিকেটসর্বস্ব, লোকদেখানো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেই মনে হয় জীবনের সব শেষ হয়ে গেল। অভিভাবক, শিক্ষকদের বোঝাতে হবে কাগজের সনদের চেয়েও জীবন অনেক বিশাল।
আত্মহননের সিদ্ধান্ত দুভাবে মনে আসে। একটি হচ্ছে হঠাৎ করে কোনো অপমান, নির্যাতন কিংবা অবসাদ থেকে মৃত্যুর চিন্তা। যেমন- ধর্ষণ, আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেয়া কিংবা পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের পর আত্মহত্যা। আরেকটি হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে মৃত্যুর পরিকল্পনা সাজিয়ে রাখা। চিকিৎসক ও মনোবিদরা গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন এসব ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁঁকি কাজ করে থাকে। এরকম কিছু ঝুঁকির কথা এখানে উল্লেখ করছি।
- অতীতে আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা। মৃত্যু নিয়ে অতিরিক্ত আতঙ্কবোধ।
- মেয়েরা সাধারণত নিজের শরীরের ক্ষতি করে। আর ছেলেরা চলে যায় সরাসরি হননে।
- নিম্ন আর্থসামাজিক শ্রেণী।
- সম (বা উভ) কামিতা
- পড়ালেখায় অনগ্রসরতা
- শিক্ষক বা অভিভাবকদের পরীক্ষায় ফলাফল নিয়ে সবসময় মাত্রাতিরিক্ত চাপ
- অভিভাবকের বিচ্ছেদ, পারিবারিক অশান্তি, পরকীয়া, আসক্তি, মানসিক অসুস্থতা কিংবা মৃত্যু
- শৈশবের কোনো তিক্ত চরম অভিজ্ঞতা
- শিশু বয়স থেকে ধ্বংসাত্মক কার্টুন, গেমস বা সিনেমা দেখার অভ্যাস
- পরিবার কিংবা পরিচিতজনে আত্মহত্যার অভিজ্ঞতা
- পরিবার, ক্লাসরুম কিংবা সামাজিক আবহে দ্বন্দ্ব, রেষারেষি, নিগ্রহ বা ‘বুলি’ করা
- ধূমপান, মাদকাসক্তি
- মানসিক অস্থিরতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা, নিজেকে অসহায় মনে করা
- কিছু মানসিক অসুস্থতা। যেমন- অবসাদ, উদ্বেগ, শুচিবাই, অতি-চঞ্চলতা, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতি
- সমাজে, রাষ্ট্রে অপরাধের বিচার না হওয়ার নজির, প্রবণতা কিংবা বিচারব্যবস্থায় আস্থাহীনতা। বিচার চাইতে গেলে উল্টো নির্যাতিতের দিকে আঙুল ওঠার প্রবণতা।
একজন অভিভাবক, শুভাকাক্সক্ষী কিংবা সচেতন নাগরিক যদি এসব ঝুঁকির মধ্যে থাকা পরিচিতজনকে সন্দেহ করেন, তার উচিত তাকে সুস্থপথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা। মানসিক চিকিৎসক, কাউন্সিলর এ ব্যাপারে আরো বিষদ পথ দেখাতে পারবেন। ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক, সামাজিক, অ্যাকাডেমিক আবহের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা এবং পদক্ষেপ নেয়া সময়ের দাবি।
স্রোতের মতো নিম্নগামী মানবিক মূল্যবোধ, অবক্ষয়, নেশার উপকরণের সহজলভ্যতা, মুঠোফোন আর অন্তর্জালের অযাচিত কুরুচিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে কী বলা উচিত? কোভিড কিংবা ক্যান্সার প্রতিরোধে আমরা কত পরামর্শই তো বাতলে দিই। কিন্তু সভ্যতার বেশ ধরে মস্তিষ্কের কোষে কোষে দানা বাধা এই মরণ ভাইরাসগুলো কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?
খুব ছোটবেলা থেকে শিশুদের মানসিক যতœ নিতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ বোঝাতে হবে। কী কার্টুন দেখছে, টিভিতে কোন অনুষ্ঠান দেখছে এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ থেকে মাদকের ভয়াল থাবা রুখতে হবে। মাদক, ইয়াবা, আইস প্রভৃতি একটি প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে। কিশোর গ্যাং, র‌্যাগিং, বুলি করা, বিকৃত টিকটকের মতো অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ করতে হবে। কিশোরকে বোঝাতে হবে, আত্মহত্যা নয়, সমস্যাকে সামনে থেকে লড়াই করার নামই জীবন।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ , আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১২২৪২১৬৮
ahadnann@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল