২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাদ্যাভ্যাস ও কায়িক পরিশ্রমে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ

খাদ্যাভ্যাস ও কায়িক পরিশ্রমে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ -

কোলেস্টেরল নিয়ে ভীত নন এমন স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। তবে কোলেস্টেরলের একটা নেগেটিভ ভাবমূর্তি সবার মাঝে বেশ প্রবল। সবাই মনে করেন কোলেস্টেরল মানেই খারাপ সংবাদ। বিষয়টি আসলেই কি তাই।
কোলেস্টেরল আসলে কী?
কোলেস্টেরল হলো তৈলজাতীয় একধরনের বস্তুকণা যা প্রাণীর দেহে বিশেষ করে লিভারে তৈরি হয়। এটি স্টেরয়েড জাতীয় বস্তু এবং দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। দেহের সব কোষের ঝিল্লি বা মেমব্রেনের বিল্ডিং ব্লক বা গড়নের উপাদান হলো এই কোলেস্টেরল। ভিটামিন ডি, সেক্স হরমোন যেমন টেস্টোস্টেরন ও এস্ট্রোজেন ইত্যাদি তৈরিতেও এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আবার গল ব্লাডার থেকে যে বাইল সল্ট নিঃসৃত হয়ে পরিপাকতন্ত্রে হজমে সহায়তা করে সেই বাইল সল্ট বা জারক রসের উপাদানও এই কোলেস্টেরল। এমন যে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান তাকে নিয়ে এত ভয় কেন?
কোলেস্টেরলের উৎস
দেহ দুইভাবে কোলেস্টেরল পেয়ে থাকে। দেহাভ্যন্তরে নিজস্ব প্রস্তুতকৃত কোলেস্টেরল যাকে বলা হয় ডি নভো সিনথেসিস। ডি নভো সিনথেসিসের প্রধান উৎস হলো লিভার। তবে স্বল্প পরিমাণে কোলেস্টেরল পরিপাকতন্ত্র, মস্তিষ্ক, এডরেনাল গ্লেন্ড ও সেক্স অরগানে তৈরি হয়ে থাকে। লিভারের মাধ্যমে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দৈনিক ১ গ্রাম বা ১০০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল প্রস্তুত করে থাকে। প্রয়োজনের দুই-তৃতীয়াংশ কোলেস্টেরল এভাবে দেহাভ্যন্তরেই তৈরি হয়ে থাকে। দ্বিতীয় উৎস হলো খাবার। খাবারের মধ্যে মাংস (রেড মিট), ডিম, লিভার, কিডনি, ভোজ্যতেল, বাটার ইত্যাদি। খাবার থেকে দৈনিক প্রাপ্ত কোলেস্টেরলের পরিমাণ হলো ৩০০-৫০০ মিলিগ্রাম।

দেহে কোলেস্টেরল পরিবহন ব্যবস্থা
কোলেস্টেরল বড় নিরীহ বস্তু। এটি দেহে একা একা পরিবাহিত হতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন ক্যারিয়ার বা বাহন। খাবার থেকে সংগৃহীত কোলেস্টেরলের বাহন হলো কাইলোমাইক্রন। কাইলোমাইক্রোন একটি কমপ্লেক্স যার কেন্দ্রে থাকে ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরল। এখানেও কোলেস্টেরল ফ্রি ফ্যাটি এসিডের সাথে যুগলবন্দী হিসেবে থাকে। (কোলেস্টেরল ও ফ্যাট ভিন্ন বস্তু)। এটিকে বলা হয় কোলেস্টেরল এস্টার। কাইলোমাইক্রনের বাইরের দিকটি একটি ঝিল্লির মতো আবরণবিশেষ যাকে বলা হয় লাইপোপ্রোটিন যার গায়ে কিছু ফ্রি বা মুক্ত কোলেস্টেরল কণা গেঁথে থাকে। লাইপোপ্রোটিন হলো লিপিড ও প্রোটিনের সংমিশ্রণে। এই কাইলোমাইক্রন লিমফেটিক সিস্টেমের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করে। রক্তে প্রবাহিত হওয়ার সময় রক্তনালীর গায়ের এক ধরনের এনজাইম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাইলোমাইক্রন থেকে প্রথমে ট্রাইগ্লিসারাইড বের হয়ে কোষে প্রবেশ করে জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য। পেছনে রক্তে থেকে যাওয়া অংশটি হলো কাইলোমাইক্রন রেমনেন্ট। কাইলোমাইক্রন রেমনেন্টে থাকে কিছু লাইপোপ্রোটিন, ট্রাইগ্লিসারাইড ও প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল। এটি রক্ত থেকে লিভারে পৌঁছে। লিভার অভ্যন্তরে এই রেমনেন্ট থেকে তৈরি হয় কোলেস্টেরল ও ভিএলডিএল। এই ভিএলডিএল রক্তে প্রবেশ করে প্রবাহিত হতে থাকে এবং জায়গায় জায়গায় প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড ও কোলেস্টেরল কোষে সরবরাহ করতে থাকে। এভাবে ফ্যাটি এসিড ও যৎসামান্য কোলেস্টেরল হারিয়ে ভিএলডিএল প্রথমে আইডিএল এবং পরে এলডিএলে রূপান্তরিত হয়। কোষ নিজস্ব প্রয়োজনাতিরিক্ত কোলেস্টেরল উদগীরণ করে রক্তে পাঠিয়ে দেয়। এইচডিএল নামক অন্য একটি লাইপোপ্রোটিন এই উদ্বৃত্ত কোলেস্টেরলকে লিভারে পৌঁছে দেয়। এইচডিএল ও একধরনের লাইপোপ্রোটিন যারে তৈরি হয়। অর্থাৎ রক্তে কোলেস্টেরলের বাহন হলো লাইপোপ্রোটিন। এভাবে দেখা যায় এইচডিএল, ভিএলডিএল, আইডিএল, এলডিএল এসব লাইপোপ্রোটিন আসলে একধরনের ক্যারিয়ার বা বাহন যার মাধ্যমে ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরল রক্তে পরিবাহিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ এসব লাইপোপ্রোটিন হলো লিপিড ও কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক পরিবহন ব্যবস্থা। বিপত্তিটা হয় যখন কোলেস্টেরল সরবরাহ ব্যবস্থার আধিক্য দেখা দেয়।

কোলেস্টেরলের বিপত্তি
কাইলোমাইক্রন রেমনেন্ট যেগুলো আকারে বড় সেগুলো পুরোটাই লিভারে ফেরত এলেও ছোট আকারের কিছু কিছু কাইলোমাইক্রন রেমনেন্ট রক্তনালীর গায়ে সেঁটে যায় এবং প্লাগ তৈরি করে। বিশেষ করে কাইলোমাইক্রন রেমনেন্ট মাত্রারিক্ত হলে তখন লিভার রক্ত থেকে সব রেমনেন্ট শুষে নিতে পারে না। এর সাথে ফ্রি কোলেস্টেরল গাঁটছড়া বেঁধে রক্তনালীকে ব্লক করে দেয়। ফলে হৃদরোগের মতো সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। রক্ত থেকে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, এলডিএল বা কাইলোমাইক্রনকে লিভারে সরিয়ে নিতে হলে প্রচুর পরিমাণে এইচডিএল প্রয়োজন। এইচডিএল এথিরোমা বা রক্তনালী ব্লককে প্রতিরোধ করে থাকে। এখানে অনেকে এলডিএলকে খারাপ ও এইচডিএলকে ভালো কোলেস্টেরল এভাবে উল্লেখ করে থাকেন। আসলে এটি একটি সার্বিক কোলেস্টেরল ও লিপিড ব্যবস্থাপনার বিষয়। এথিরোমা বা কোলেস্টেরল প্লাগজনিত হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে হলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি।

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে খাদ্যভ্যাসের ভূমিকা
খাবারের সাথে যখন আমরা কোলেস্টেরল গ্রহণ করি তখন তার সবটুকু রক্তে প্রবেশ করতে পারে না। আবার লিভার থেকে গল ব্লাডার হয়ে বাইল সল্ট বা জারক রসের মাধ্যমেও কোলেস্টেরল খাদ্যনালীতে পৌঁছায়। খাদ্যনালী থেকে প্রায় অর্ধেক কোলেস্টেরলই রক্ত শুষে নিতে অক্ষম। আবার যখন খাদ্যে সবজি ফলমূল ইত্যাদি আঁশযুক্ত খাবারের প্রাধান্য থাকে তখন প্রায় ৭৫ শতাংশ কোলেস্টেরল রক্তে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে পয়ঃনিষ্কাশনে বেরিয়ে যায়। বিপরীতে খাদ্যে সেচুরেটেড ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার যেমন গোশত, ডিম, বাটার, চিজ, দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদির প্রাধান্য থাকলে তখন অধিকতর কোলেস্টেরল রক্তে প্রবেশের সুযোগ পায়।
আঁশযুক্ত খাবার বা শাকসবজি দু’ভাবে খাদ্যনালী থেকে কোলেস্টেরলকে রক্তে প্রবেশে বাধা দিয়ে থাকে। প্রথমত কোলেস্টেরল সরাসরি আঁশ বা ফাইবারের সাথে সেঁটে যায়। আমরা জানি আঁশ বা ফাইবার খাদ্যনালী থেকে রক্তে প্রবেশ করতে পারে না, বরং পয়ঃনিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে নির্গমন করে থাকে। আবার উদ্ভিদজাতীয় অনেক খাবারে স্টেরল যৌগ থাকে যা কোলেস্টেরলকে রক্তে প্রবেশে সরাসরি বাধা প্রদান করে থাকে। স্টেরল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় কমলা লেবু ও মারজারিনে। আঁশ বা ফাইবারসমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে ওটস, কলা, আপেল, বেরিজ, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি উল্লেখযোগ্য।

দেহাভ্যন্তরে প্রস্তুতকৃত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ
দেহাভ্যন্তরে প্রস্তুতকৃত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ খাদ্যাভ্যাসের মতো সহজ নয়। তবে কায়িক পরিশ্রম করলে দেহে কোলেস্টেরলের ব্যবহার বেড়ে যায় ফলে রক্তে এর আধিক্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে এইচডিএলের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এইচডিএল বৃদ্ধি করে বেশ সুফল পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া স্টেটিনজাতীয় ওষুধ লিভারে কোলেস্টেরল তৈরির মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
রক্তে এইচডিএল বৃদ্ধির উপায়
নিয়মিত ব্যায়াম; ধূমপান পরিহার করা; মাছ, ফলমূল ও সবজিসমৃৃদ্ধ খাবার গ্রহণ; চিনি বা সুগারসমৃদ্ধ খাবার পরিহার করা- এসবই রক্তে এইচডিএলের পরিমাণ বৃদ্ধি করার উপায়। অলিভ অয়েল এইচডিএল বৃদ্ধি করে আবার একই সাথে এলডিএলের পরিমাণ বা মাত্রা হ্রাস করে থাকে। ফ্যাটজাতীয় খাবারের সাথে অবশ্যই সবজি, ফলমূল ইত্যাদি খাবার থাকাটা ভালো। সুগার বা মিষ্টিজাতীয় খাবারের বিকল্প হিসাবে বাদাম খাওয়ার অভ্যাস করা যেতে পারে।
প্রাথমিকভাবে খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে দেহের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা উচিত। এতে ব্যর্থ হলে তবেই ওষুধের সাহায্য নেয়া উচিত। মনে রাখতে হবে দেহের স্বাভাবিক চাহিদা মেটানোর জন্য দৈনিক আমরা যে ক্যালরি গ্রহণ করি তার ৩০ শতাংশ ক্যালরি নিতে হবে ফ্যাটজাতীয় খাবার থেকে। অর্থাৎ ফ্যাট পুরোপুরি পরিহার করতে গেলে তখন দেহের হরমোন, ভিটামিন ডি, এনজাইমসহ দেহের কোষাভ্যন্তরে গঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বিপর্যয় দেখা দেবে। ঝুঁকি এড়াতে তাই ফ্যাট বা কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার বর্জন করার চেয়ে পরিমাণ মতো গ্রহণ এবং খাদ্য তালিকায় অবশ্যই আঁশযুক্ত খাবারের প্রাধান্য দিতে হবে।
লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমএস (চক্ষু); চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক- জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল। কনসালট্যান্ট-আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার, ৩৮/৩-৪ রিং রোড, আদাবর, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement