২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাথায় যখন এটমবোম

মাথায় যখন এটমবোম -

শিরোনাম দেখে অনেকেই আঁৎকে উঠবেন। ভাববেন মাথায় আবার এটমবোম হয় নাকি! আমি মিথ্যা বলছি না। মাথায় অনেকেই এটমবোম নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
আমি যে এটমবোমের কথা বলছি তা মস্তিষ্কের রক্তনালীর একটি রোগ। কী সে রোগ জানতে চান? আজকে এটা নিয়েই আলোচনা করব।
মস্তিষ্কে অনেকগুলো রক্তনালী থাকে। এগুলো জালের মতো বিস্তৃত হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সরববাহ করে। একটি রক্তনালী ভাগ হয়ে দুটো শাখায় পরিণত হয়। রক্ত চলাচলের সময় এ ভাগ হওয়া অংশে রক্তের চাপ পড়ে বেশি। ফলে রক্তনালীর এ অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। চাপ বেড়ে গেলে এ দুর্বল অংশ ফুলে যায়। যেটাকে বলে এনিউরিজম। একসময় এনিউরিজম ফেটে যায়। ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে রক্ত মস্তিষ্কের আবরণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর একেই বলে সাব-এরাকনয়েড হেমোরেজ।
তো এ রোগকে এটমবোম বলা হচ্ছে কেন? কারণ হলো গবেষণালব্ধ তথ্য মতে, এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ১০-২০ শতাংশ মারা যান হাসপাতালে পৌঁছার আগেই। আরো ৩০-৪০ শতাংশ মারা যান প্রথম ৩০ দিনের মধ্যেই। মানে মোট আক্রান্তের ৫০ শতাংশ মারা যান প্রথম ৩০ দিনের মধ্যে। তাহলে প্রশ্ন বাকি অর্ধেকের কী হয়? জীবিতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকেন। কাজেই এ রোগটি প্রাণহারী।
কেন হয় এ রোগ?
এ রোগ কেন হয় তার সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে কিছু কিছু কারণে ফুলে যাওয়া রক্তনালী ফেটে যাওয়ার সম্ভতৃণা বেড়ে যায়। সে কারণগুলো হলো :
১. ধূমপান
২. উচ্চ রক্তচাপ
৩. পরিবারে এ রোগের ইতিহাস থাকলে
৪. মদপান
৫. কিডনির রোগ অটোসোমাল ডমিনেন্ট পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ, এটি বংশগত কিডনির রোগ। এ রোগে পুরো কিডনিজুড়ে অনেক সিস্ট হয়। কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিডনির সাথে লিভার বা অন্যান্য অঙ্গে সিস্ট হতে পারে। সেই সাথে মস্তিষ্কের রক্তনালী ফুলে গিয়ে এনিউরিজম হতে পারে।
উপসর্গ কি
সাব-এরাকনয়েড হেমোরেজের মূল কারণ- এনিউরিজম যেটিকে আমি এটমবোম বলছি সেটি মাথায় থাকলে কিন্তু কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যদি না সেটি বড় হয়ে টিউমারের আকার ধারণ করে।
এটমবোম বাস্ট হলে যেমন প্রাণহানি হয় ঠিক তেমনি এনিউরিজম রাপচার বা ফেটে গেলে উপসর্গ দেখা দেয়।
এ রোগের উপসর্গ শুনেই রোগ নির্ণয় করা যায়। মূল ও প্রধান উপসর্গ হলো মাথাব্যথা। শুধু মাথাব্যথা নয় তীব্র মাথাব্যথা। এমন মাথাব্যথা জীবনে কখনোই হয়নি। অনেকে বলেন মাথায় বাজ পড়ার মতো ব্যথা। ব্যথা শুরু হয়ে কিছু সময়ের মধ্যে খুব তীব্র আকার ধারণ করে। অনেকের মাইগ্রেন থাকে তাদেরও তো মাথাব্যথা হয়। তাহলে তারা কিভাবে আলাদা করবেন? তারা আলাদা করবেন এভাবে যে এমন তীব্র মাথাব্যথা এর আগে কখনো হয়নি। শুধু মাথাব্যথা নিয়েই এক-তৃতীয়াংশ রোগী হাসপাতালে আসেন।
তবে মাথাব্যথার সাথে বমি হতে পারে, আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হতে পারেন। আক্রান্তের ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, চোখের পাতা পড়ে যেতে পারে, শরীরের কোনো পাশ অবস হতে পারে ও চোখে দেখার সমস্যা হতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
এ রোগ নির্ণয়ে মাথার সিটিস্ক্যান করা হয়। বেশির ভাগ রোগীর সিটিস্ক্যানে মস্তিষ্কের আবরণীতে রক্ত ধরা পড়ে। তবে রক্তক্ষরণ যদি কম হয় তাহলে কিন্তু সিটিস্ক্যানে এ রোগ নাও ধরা পড়তে পারে। এমনটি হলে নিউরোলজিস্টরা পিঠের হাড়ের মধ্যের রস নিয়ে পরীক্ষা করে এ রোগ নির্ণয় করতে পারেন। আর মাথার এটমবোম বা এনিউরিজম নির্ণয় করার জন্য কনট্রাস্ট বা ওষুধ দিয়ে সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করতে হয়। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম করতে হয় যেটাকে আমরা বলি ডিজিটাল সাবট্রাকশন এনজিওগ্রাম বা সংক্ষেপে ডিএসএ। অত্যাধুনিক এ পরীক্ষাটি এখন আমাদের দেশেই হচ্ছে হরহামেশাই।
চিকিৎসা কি?
প্রথমে একটা সুখবর দিতে চাই। বাংলাদেশে এ রোগের অত্যাধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশে এ চিকিৎসা হয়। এ অত্যাধুনিক চিকিৎসাকে বল্র কয়েল অ্যাম্বোলাইজেশন। এটি এক ধরনের সার্জারি তবে মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারি। মানে এ অপারেশনে মাথা কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন পড়ে না। কুঁচকিতে ক্যানুলার পরানোর পর ক্যাথেটার ও ওয়ারের সাহায্যে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে প্রবেশ করা হয়। এরপর এনিউরিজমে প্রবেশ করে কয়েল বা বিশেষ ধরনের তার বসিয়ে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে এনিউরিজম ফেটে গিয়ে আর রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে না।
দেশের মধ্যে আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে একটি বিভাগ আছে। এরা এভাবে অপারেশন করে। খুব দক্ষ, প্রশিক্ষিত টিমের মাধ্যমে সরকারিভাবে এ সেবা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অল্পবিস্তর এ ধরনের অপারেশনের সুযোগ আছে। বেসরকারিভাবে দু-একটি জায়গায় এ অপারেশন হচ্ছে। এ অপারেশনের ঝুঁঁকি খুব কম। রোগী দু-চার দিনের মধ্যেই বাসায় যেতে পারেন।
আরেকটি পদ্ধতি হলো মাথা কেটে অপারেশন করা। এ ক্ষেত্রে মাথা কেটে এনিউরিজম খুঁজে বের করে ক্লিপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়।
আমার মাথায় কি এটমবোম আছে?
খুব জটিল প্রশ্ন। এটমবোম ফেটে না যাওয়া পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই। তবে কোনো কারণে সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করতে গিয়ে এটি না ফাটলেও ধরা পড়তে পারে। তাহলে কি আমরা সবাই সিটিস্ক্যান করব? না, এর প্রয়োজন নেই। কারণ খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মস্তিষ্কে এনিউরিজম থাকে। আবার যাদের এনিউরিজম থাকে তাদের সবার ফেটে যায় না। কাজেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খোঁজার দরকার নেই। তবে যাদের পরিবারে নিকটাত্মীয়দের (যেটাকে আমরা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেশনশিপ বলি) যদি দু’জন বা এর বেশি জনের এ রোগ দেখা দেয় ও কিডনির রোগ অটোসোমাল ডমিনেন্ট পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ থাকে তাহলে অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
লেখক : নিউরোলজিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস


আরো সংবাদ



premium cement