২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিশুর বাড়তি খাবার কেমন হবে

শিশুর বাড়তি খাবার কেমন হবে -

অনেক মায়েরাই শিশুদের কী খাবার দেবেন, কখন দেবেন, কী পরিমাণে দেবেন- এসব ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করে রীতিমতো আতঙ্ক বোধ করেন। খুব সহজে একটি নিয়মের মধ্যে, হাতের কাছে পাওয়া যায়, এমন ঘরের হাঁড়ির খাবার দিয়েই শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায়। মায়েদের সুবিধার জন্য কিছু টিপস দিচ্ছি।
১. বাড়তি খাবার শুরু করা : জন্মের পর প্রথম ছয় মাস (১৮০ দিন) শিশুকে শুধু বুকের দুধ দিতে হবে। এরপরে বাড়তি খাবার শুরু করতে হবে। যদি একটু আগে আগেই বাড়তি খাবার শুরু করা হয়, তবে কিছু সমস্যা হতে পারে। যেমন- পুষ্টিঘাটতি, অ্যালার্জিজনিত সমস্যা, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আবার ছয় মাসের অনেক পরও আদর্শ বাড়তি খাবার শুরু না করলে রক্তশূন্যতা, ক্ষীণ স্বাস্থ্য, অপুষ্টি, ঘন ঘন সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
২. সঠিক খাবার বাছাই : আমাদের খাবারগুলো মূলত তিনটি কাজ করে। কিছু খাবার শক্তি দেয় (যেমন- চাল, যব বা গমজাতীয় শস্য, চিনি, আলু, তেল, ঘি, কুসুম, কলিজা, মাখন), কিংবা দেহ তৈরিতে ভূমিকা রাখে (ডিম, মাছ, গোশত, ডাল, দুধ, শিমের বীচি), অথবা রোগ প্রতিরোধ করে (ফল, রঙিন শাকসবজি)। খাবার তৈরিতে এ তিন ধরনেরই খাবারের অংশ থাকতে হবে। শিশুরা বয়সের তুলনায় শক্তি বেশিই খরচ করে ফেলে। তাই তেলজাতীয় খাবার তাদের একটু বেশি দেয়াই উচিত। প্রতিদিন অন্তত একটি প্রাণিজ আমিষ খাবার থাকতে হবে।
৩. স্বাদে বৈচিত্র্য : প্রতিদিন একই দুধু সুজি, কিংবা একই ধরনের খিচুড়ি খাদ্যগ্রহণে অনীহা আনে। ভাতের সাথে সবজিতে বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে। একদিন মাছ, পরের দিন কলিজা কিংবা গোশত দিলে নতুনত্ব আসবে। আর বিভিন্ন মৌসুমি ফল তো আছেই। সুজির সাথে দুধ, নারিকেলের দুধ, ডিমের সাদা অংশ, ডাল মেশানো যেতে পারে।
৪. খাবার ব্লেন্ড করা : দয়া করে এই কাজটি কখনো করবেন না। শিশুর খাবার একটি চামচে নিয়ে কাত করলে সহজে পড়বে না, এমন ঘনত্বের হওয়া উচিত। ব্লেন্ড করে বেশি পাতলা খাবার দিলে পুষ্টিকণিকা ভেঙে যাওয়া, মাড়ি মজবুত হতে বিলম্ব হওয়া, খাবার গিলতে সমস্যা হয়ে থাকে। এই শিশুগুলো স্কুলে যাওয়ার বয়সেও একটু ঘন কিংবা দানাদার খাবার গিলতে না শিখে বমি করে দেয়। প্রয়োজনে হাত দিয়ে খাবার নরম করুন, ব্লেন্ডার দিয়ে নয়।
৫. খাবারের পরিমাণ : ছয় থেকে আট মাসে এক পোয়া স্যুপের বাটির অর্ধেক দুইবার, ৯ থেকে ১২ মাসে তিনবারের সাথে পুষ্টিকর নাশতা, ১২ মাসের পর এক বাটি তিনবারের সাথে দুই বেলা পুষ্টিকর নাশতা দেয়া উচিত। কোনো শিশুই হঠাৎ করে খাওয়া শেখে না। তাই ধৈর্য ধরে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হয়।
৬. খাবার নিয়ে ‘যুদ্ধ’: শিশুকে জোরাজুরি করে খাওয়াবেন না। একবার খাওয়ানোর পর আবার ক্ষুধা লাগতে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে হবে। জোর করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা, মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা আর ভয়ের জন্ম নেয়। অতিরিক্ত সময় নিয়ে খাওয়ালে শিশুরা নিজেদের অতি গুরুত্বপূর্ণভাবে আর পরবর্তী সময়ে একরোখা, দাম্ভিক হতে পারে। অনেকে ঘুমের সময় শিশুর মুখে ফিডার ধরিয়ে দেন। এতে কান পাকা রোগ হতে পারে। শিশুকে টিভির সামনে বসিয়ে খাওয়াবেন না। এতে খাবারের স্বাদ আস্বাদনে বিঘœ ঘটে।
৭. নিজের হাতে খেতে উৎসাহ দিন : ৯ মাস হলেই শিশুকে নিজের হাতে খেতে উৎসাহ দিন। প্রথম দিকে ও হয়তো পারবে না। আপনি সাহায্য করুন, কিন্তু নিজের হাতে খাবার লাগাতে বাধা দেবেন না। নিজের হাতে খেলে শিশুদের খাওয়ার প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে, পরবর্তী সময়ে আত্মবিশ্বাসী হবে আর নিজের কাজ নিজে করতে শিখবে।
৮. প্যাকেটজাত, বিদেশী খাবারপ্রীতি : ছোট অবস্থাতে কৌটার দুধ, সিরিয়ালজাতীয় খাবার, বড় হলে চিপস, জুস, চকোলেট- এ সবই শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাইরের দুধ, সিরিয়াল খেলে স্বাভাবিক সুস্থ রুচি তৈরিতে বিঘœ ঘটে। প্যাকেটজাত খাবারে বিভিন্ন প্রিজারভেটিভ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আবার ফল বাছাইয়ে বিদেশী কেমিক্যালযুক্ত আঙুর, মাল্টা, নাশপাতির চেয়ে দেশী ছোট কলা, সফেদা, আতা, গাব, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, গ্রীষ্মের আম, কাঁঠাল, জাম, শীতের কমলা পছন্দ করুন। মৌসুমের আগে আগে যে ফল পাওয়া যায়, আবার মৌসুম শেষ হওয়ার অনেক দিন পরও যে ফল বাজারে থাকে, সেগুলো না দেয়াই ভালো।
৯. গরুর দুধ : আমিষের চাহিদা মেটাতে শিশুকে গরুর দুধ দেয়া যেতে পারে। বয়স এক বছর পূর্ণ হলে পানি না মিশিয়ে, চিনি না দিয়ে গরুর দুধ দিতে পারেন (সূত্র : শিশু ও হাসি- প্রফেসর ডা: এ আর এম লুৎফুল কবীর)।
১০. খাবার নিয়ে আতঙ্ক : অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেক মায়ের কাছেই শিশুদের খাওয়ানো রীতিমতো আতঙ্ক, যুদ্ধ, যন্ত্রণার কারণ হয়ে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো পরিবারে। তাই অযথা দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন। পুরো পরিবার সময় নিয়ে একসাথে আনন্দময় পরিবেশে শিশুকে নিয়ে খেতে বসুন। একটি সুস্থ সুন্দর উদাহরণ স্থাপন করুন। শিশু নিজেই তার খাবার খেতে শিখে যাবে।
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement