২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিশুদের করোনার টিকা

৫ থেকে ১২ বছরের শিশুদের কেন করোনার টিকা দেবেন?
শিশুদের করোনার টিকা -

প্রথম দিকে কেন শিশুদের করোনা হতো না
করোনাভাইরাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর স্পাইক প্রোটিন। এটি ভাইরাসের চার পাশে আঁকশির মতো ছড়ানো থাকে। করোনাভাইরাস কাউকে সংক্রমিত করতে তখনই সফল হয়, যখন তার আঁকশিগুলো শ্বাসতন্ত্রের দেহকোষের বাইরের আবরণের এসিই-২ রিসেপ্টর পেঁচিয়ে ধরে কোষের ভেতর ঢুকে তার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে। এরপর ভাইরাস অনায়াসে তার বংশ বিস্তার করতে থাকে। কিন্তু সেই রিসেপ্টর না থাকলে ভাইরাস দেহকোষের ভেতরে ঢুকতে না পেরে বিনষ্ট হয়ে যায়।
যেহেতু শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের ভেতরের দিকের কোষে (সেল) এই এসিই-২ রিসেপ্টরগুলো প্রায় থাকেই না, তাই শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল খুবই কম। তবে তাদের নাক, মুখ ও গলায় এই রিসেপ্টর সাধারণভাবেই বেশি থাকে। তাই তাদের সংক্রমণ সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের উপরের দিকেই কিছুটা হয়, কিন্তু ফুসফুস পর্যন্ত যেতে পারে না। কারণ আগেই বলেছি, সেখানে তো রিসেপ্টর প্রায় থাকেই না।
এটি ঠিক যেসব শিশু মাঝে মধ্যেই সর্দি-কাশি-জ্বরে ভোগে। এগুলো হয়তো ভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাসের অসুখ। এসব ভাইরাসের অ্যান্টিবডি শিশুদের শরীরে থাকে, ওগুলোই হয়তো কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে এসেছেন, শিশু ও কিশোর-তরুণদের অনেকের কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে।
সায়েন্স ম্যাগাজিনে বছর দু’য়েক আগে প্রকাশিত এক নিবন্ধে গবেষকরা বলেছেন, মাত্র ৫ শতাংশ পূর্ণবয়স্কের এ ধরনের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু শিশুদের ৪৩ শতাংশ রোগ প্রতিরোধী। যাদের রক্ত কোভিড-১৯ অতিমারীর আগে সংগৃহীত হয়েছিল, তাদের রক্তে এই নতুন করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি থাকবে না বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু তারা দেখলেন, শিশু ও পূর্ণবয়স্কদের কারো কারো নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধী অন্তত একটি গুণসম্পন্ন অ্যান্টিবডি রয়েছে। এই অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসের স্পাইকের সাথে যুক্ত হয়। ফলে ভাইরাস রক্তের সেলে ঢুকতে পারে না।
তা ছাড়া শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের রক্ষা করে। এখানে তাদের টি-সেল বিশেষ ভূমিকা পালন করে। টি-সেল হলো রক্তের একধরনের শ্বেতকণিকা, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অংশ। টি-সেল দেহের বোনম্যারো থেকে উৎপন্ন হয় এবং থাইমাস গ্ল্যান্ডে পরিপূর্ণতা লাভ করে। শিশুদের থাইমাস গ্ল্যান্ডগুলো খুব সক্রিয়। যেহেতু শিশুরা দ্রুত টি-সেল উৎপাদন করতে পারে, তাই ভাইরাস শিশুদের টি-সেল ধ্বংসের আগেই শিশুদের দ্রুতগতিতে উৎপন্ন টি-সেল ভাইরাস ধ্বংস করতে পারে।

তা হলে এখন কেন শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে
সম্প্রতি একটি টিভি আলোচনায় বিশিষ্ট টিকা বিশেষজ্ঞ ডা: তাজুল এ বারি বলেছেন, ‘আমরা যে টিকা ব্যবহার করছি, তা মূলত সেই ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আদি কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। কিন্তু এরপর দ্রুতই কোভিডের রূপান্তর ঘটতে থাকে; অর্থাৎ কোভিডের নতুন নতুন ধরন সৃষ্টি হয়। যেমন আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা, অমিক্রন এবং এর বিভিন্ন উপধরন, বিশেষত বিএ.৪ ও বিএ.৫ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এর বিপরীতে প্রচলিত টিকা এসব নতুন ধরন রোধে যথেষ্ট কার্যকর নয়। তাই দরকার হাইব্রিড টিকা, যা কোভিডের সাম্প্রতিক ধরনগুলোর বিরুদ্ধেও দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। এ ধরনের তিনটি টিকা এখন প্রায় তৈরি। হয়তো শিগগিরই বাজারে আসবে। এর আগে অমিক্রনের এসব ধরন ও উপধরনের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই শিশুদের টিকা দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তবে তাদের টিকা বড়দের টিকার চেয়ে একটু আলাদা এবং এর মাত্রাও কম।
করোনাভাইরাস অবিরাম রূপান্তর ঘটার প্রক্রিয়ায় এমন অবস্থানে এসেছে যে শিশুরাও আর আগের মতো করোনাভাইরাস প্রতিহত করতে পরছে না। বিশেষভাবে বিএ.৪ ও বিএ.৫-এ দু’টি ধরন মারাত্মক। এদের স্পাইক প্রোটিন খুব সহজেই সেলের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে। এর ফলে এরা দ্রুত তাদের বংশবিস্তার করে এবং সহজেই ভাইরাসটি টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। তবে সহজে বংশবিস্তারের এই যোগ্যতা অর্জন করার বিপরীতে করোনাভাইরাসকে তাদের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হারাতে হয়েছে। সেটা হলো তাদের সংক্রমণের তীব্রতা। এখন করোনা খুব সহজে আক্রান্ত করতে পারে বটে, কিন্তু এর উপসর্গ প্রায় থাকেই না। সামান্য সর্দিকাশি। দু’য়েক দিন গলাব্যথা। এরপর হয়তো পাঁচ দিনেই করোনা নেগেটিভ।
তবে যাদের আগে থেকেই শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা থাকে, দুর্বল ফুসফুস বা হৃদযন্ত্রের রোগ থাকে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি-লিভারের সমস্যা থাকে, তাদের জন্য সংক্রমণ তীব্র হতে পারে। করোনার নতুন ধরন শিশু থেকে প্রবীণ- সবাইকে আক্রান্ত করলেও হয়তো তাদেরকে হাসপাতালে যেতে হয় না। মৃত্যুর হারও কম।

কোভিড টিকা দেয়ায় লাভ কী
ষ করোনার টিকা শিশুদের কোভিডের সংক্রমণ ও কোভিডে আক্রান্ত শিশুদের দ্রুত মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিসহ নানা রকম জটিলতা এবং কোভিড-পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যা কমিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
ষ যেসব শিশুর আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- হাঁপানি, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ইত্যাদি থাকে, তাদের জন্য কোভিড টিকা নেয়া খুবই জরুরি। কারণ কোভিড সংক্রমণ হলে তাদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
ষ শিশুর আগে কোভিড হলেও এ টিকা নেয়া যেতে পারে এবং তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
ষ একই সময়ে অন্য টিকার শিডিউল থাকলেও কোভিড টিকা নিতে সমস্যা নেই।

কোভিড টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী?
অন্য টিকার মতো করোনা টিকা নেয়ার পরও ছোটখাটো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে তা টিকার লাভের চেয়ে নেহায়েতই নগণ্য। যেকোনো টিকার মতোই এতেও টিকা দেয়ার জায়গায় ব্যথা, ক্লান্তি লাগা, মাথাব্যথা, জ্বর, বমি বা বমি বমি ভাব ইত্যাদি হতে পারে। সাধারণত এগুলো এক থেকে দুই দিন থাকার পর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো বিরল।
শিশুদের ক্ষেত্রে টিকা দেয়ার ফলে যে মৃদু উপসর্গগুলো দেখা দেয়,
ষ টিকা নেয়ার স্থানে ব্যথা, ফোলা ও লাল হয়ে যাওয়া। অন্য কিছু প্রতিক্রিয়া হলো।
ষ ক্লান্তি, দুর্বলতা, হাত-পা-শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি। এসব প্রতিক্রিয়া ১ থেকে ৩ দিন স্থায়ী হতে পারে। ব্যথা উপশমে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক খাওয়ানো যেতে পারে।

বিশেষ ও রোগাক্রান্ত শিশুদের অগ্রাধিকার
ক্রনিক অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, থ্যালাসেমিয়া, জন্মগত হৃদরোগ ইত্যাদির মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হলে জটিলতার ঝুঁকি বেশি। এসব ঝুঁকিপূর্ণ শিশুকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত টিকার আওতায় আনা উচিত।
পরিশেষে দেশে কোভিড টিকা সহজলভ্য হলে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ৫-১২ বছর বয়সী সব শিশুকে অবশ্যই নির্ধারিত সূচি মেনে কোভিড টিকা দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চলা উচিত।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রেসপিরেটরি বিভাগ,
ঢাকা শিশু হাসপাতাল


আরো সংবাদ



premium cement