১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাওয়ার পর বমির ভাব কেন হয়

- ছবি : সংগৃহীত

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বমির ভাব হওয়াকে বলে Nausea।

বমির ভাব হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ খাদ্য নিজেই। তার পরে আছে কোনো ধরনের স্ট্রেস কিংবা দুশ্চিন্তা। মস্তিষ্কের রকমফের পেটেও সমস্যা তৈরি করে। সাথে আছে বিভিন্ন ধরনের রোগের সিম্পটম হিসেবে বমি কিংবা বমি বমি ভাব।
খাওয়ার পর কেন বমির ভাব হয়, কিভাবে হয়, এমন হলে কী করবেন এবং কী করে বুঝবেন কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এই নিয়েই আজকের আলোচনা।

সহজ করে Nausea হলো বমির ভাব, কিন্তু বমি না হওয়া। বমি হয়ে গেলে তো ল্যাঠা চুকে যায়, বমির চেয়ে বমির ভাব অস্বস্তিকর। তবে বমির চেয়ে ক্ষতিকর নয়। বমিতে শরীরের রাসায়নিক উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। বমির ভাবে পুরো শরীরকেই এক ধরনের আনপ্লেজেন্ট ফিলিংস দেয়। এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ বমির ভাব চলতে থাকলে শরীর দুর্বল লাগে। এক নাগাড়ে কয়েকদিন খাওয়ার পর বারবার বমির উদ্রেক হতে থাকলে শরীরে কোনো রোগের উপস্থিতির লক্ষণ হিসেবে ধরতে হবে।

অনেক কারণেই হয়ে থাকে এমন বমির ভাব। সবচেয়ে বেশি হয় খাওয়ার পরপরই। বিশেষ করে খাওয়ার ২০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে এমন বমি বমি ভাব শুরু হয় এবং এটি তিন থেকে চার ঘণ্টা থাকতে পারে। খাওয়া ছাড়া শরীরের কিছু উপসর্গে বমির ভাব হয়। যেমন- মাইগ্রেন, শরীরে সুগার বেশি কমে গেলে, দীর্ঘ সময় নির্ঘুম থাকলে, পাহাড় বা উচ্চতায় উঠলে, দীর্ঘ সময় বিষণ্ন থাকলে। কিছু কিছু ওষুধ খেলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে বমির ভাব হয়। যেমন- ক্যান্সার রোগী কেমোথেরাপি নিলে।

পুরুষের হয় না, কেবল মহিলাদের ক্ষেত্রে এমন বমির ভাব হয় প্রসূতিকালীন। প্রেগনেন্সির শুরুর সময়ে এমন বমি হওয়াকে বলে মর্নিং সিকনেস। যদিও নামটি ভুল এবং অনেকে মনে করেন সকাল বেলাতেই শুধু এমন বমির ভাব হয়। শুধু সকালেই এমন বমির ভাব হয় না। সারা দিনই এমন হতে পারে। এটি শরীরের কোনো সমস্যা নয়। এই সময়ে মহিলাদের শরীরে human chorionic gonadotropin বা HCG নামের একটি হরমোন অধিক পরিমাণে শরীরে তৈরি হয় বলে এমন বমি বমি ভাব হয়, কখনো বমিও হয়। প্রেগনেন্সির প্রথম চার পাঁচ মাস এমনটি হয়, তারপর চলে যায়।

প্রেগনেন্সির সময় এমন বমির ভাব হলে কী করবেন! প্রচুর পানি খাবেন, একসাথে বেশি খাবার না খেয়ে অল্প অল্প পরিমাণ একটু পরপর খাবেন, পর্যাপ্ত রেস্ট নেবেন, গরম খাবারে বমির ভাব বেশি হয়, তাই এই সময় ঠাণ্ডা খাবার ভালো, খাবারের পর একটু আদা চিবুতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, আদার রস বমির ভাবকে কমিয়ে দেয়।

খাওয়ার পর বারবার বমি ভাবের ৩৫ শতাংশ কারণ পেটের কোনো সমস্যা। পেপটিক আলসার থেকে আইবিএস, ক্রোনস ডিজিজ থেকে Gastroesophageal reflux disease বা GERD, গ্যাস্ট্রাইটিস থেকে গোল ব্লাডারের কোনো সমস্যায় এমন খাওয়ার পর কোনো কারণ ছাড়াই বমি বমি ভাব হয়। প্যানক্রিয়াসে কোনো ক্যান্সার দেখা দিলে এমন বমি বমি ভাব বারবার হতে পারে।

এমনটি হলে রোগটি চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা নিন। সাথে নিয়মিত ব্যায়াম, প্রয়োজনীয় পানি পান, যেসব খাবারে পেট অস্বস্তি লাগে, গ্যাস তৈরি হয়, বুক জ্বালাপোড়া করে, এমন খাবার এভয়েড করুন, পর্যাপ্ত ঘুম দিন, দুশ্চিন্তা পেটের অস্বস্তি ভাব বাড়িয়ে দেয়, তাই দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে চেষ্টা করুন, পেটে গ্যাস প্রতিরোধে আঁশযুক্ত খাবার খান।

কিছু কিছু খাদ্য নিজেই এমন বমি বমি ভাব হওয়ার কারণ। বিশেষ করে যেসব খাদ্যে কারো এলার্জি আছে। ফুড এলার্জির প্রথম লক্ষণ খাওয়ার সাথে সাথেই এমন বমি বমি ভাব হওয়া শুরুতে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের বাদাম, ডিম, দুধ, পনির, কিছু মাছ, সয়া, ময়দা, গোশত, ¯প্রাউট, খেলে বমির ভাব হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এসব ফুড বমির ভাবকে বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে যাদের এসব খাদ্যে এলার্জি আছে। এসব খাদ্য খাওয়ার পর এমন বমির ভাব হওয়ার কারণ শরীরে রসসঁহড়মষড়নঁষরহ ঊ এবং যরংঃধসরহব নামক রাসায়নিক উপাদান বের হয়, যা অনেকের এলার্জির কারণ।

খাদ্যে বিষক্রিয়া হলে বমি বমি ভাব হয়। ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাস জীবাণু কোনো খাদ্যে থাকলে তা পেটে গিয়ে পেটের ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে ইরিটেড করে বমির ভাব, এমনকি বমি করায়। বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়ার কারণে এমনটি বেশি হয়। খাবার ঠিকমতো রান্না না হলে অথবা খাদ্যে কোনোভাবে ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটলে খাদ্যটি পেটে গিয়ে বমির ভাব আনে। যেকোনো খাবার ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কিছুক্ষণ রান্না করলে তার মধ্যে কোনো ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস থাকলে মারা যায়। তাই খাবার রান্না করতে পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় কিছু সময় রান্না করলে এমন বিষক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বেশির ভাগ খাদ্যের বিষক্রিয়া হয় পর্যাপ্ত রান্না না হলে, খাদ্য কাঁচা থেকে গেলে, ভালোভাবে না ধুয়ে ফল, সালাদ কিংবা কাঁচা সবজি খেলে। বিশেষ করে সালমোনেলা, ই কলাই কিংবা লিস্টেরিয়া ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এমনটি ঘটে বেশি।

খাদ্যের বিষক্রিয়ার কারণে এমন বমি বমি ভাব তিন দিনের বেশি থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। সাথে ডায়রিয়া কিংবা বমি চলতে থাকলে ইলেকট্রোলাইটস ঘাটতি পূরণ করতে স্যালাইন খাবেন।

বমির ভাব হওয়ার কারণ খুঁজে বের করা এর প্রথম প্রতিকার। খাবারের পর এমন বারবার বমির ভাব হতে থাকলে নিচের কাজগুলো করবেন-
১. গরম পানি নয়, ঠাণ্ডা পানি খাবেন।
২. একসাথে বেশি নয়, অল্প পরিমাণ খাবার কিছুক্ষণ পর পর খাবেন।
৩. বমির ভাব এলে একটু আদা চিবুতে পারেন।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করবেন।
৫. যেসব খাবারে বমির ভাব আসে, তা পরিহার করার চেষ্টা করবেন।

৬. খাবার খাওয়ার সাথে সাথে দাঁত মাজবেন না। খাওয়ার এক ঘণ্টা পর দাঁত ব্রাশ করবেন।
৭. খাওয়ার পরপর ব্যায়াম কিংবা ভারী কোনো কাজ করবেন না।
৮. ঠাণ্ডা গরম খাবার মিক্স করে খাবেন না। খেলে হয় ঠাণ্ডা নয় শুধু গরম খাবার খাবেন।
৯. তেল জাতীয় খাবার, ভাজা পোড়া কম খাবেন।
১০. বমির ভাব বেশি হলে এক টুকরো বরফ মুখে দিন।

opurbo.chowdhury@gmail.com

কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক , লন্ডন, ইংল্যান্ড

 


আরো সংবাদ



premium cement