১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোভিডের বুস্টার ডোজ কতটা জরুরি?

-

করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা। কিন্তু বিশ্বজুড়ে টিকার স্বল্পতার কারণে নতুন নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটে চলেছে। তাই করোনার টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উঁকি দিচ্ছে তা হচ্ছে করোনা টিকার দু’টি ডোজ নেয়ার পরও আরেকটি ডোজ (বুস্টার বা তৃতীয়) নেয়ার প্রয়োজন আছে কি না? এই প্রশ্নটির সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা করোনা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করছে।
এ অবস্থায় সবার বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ সংক্রান্ত বর্তমান পরিস্থিতি জেনে রাখা প্রয়োজন।
মডার্না ও ফাইজার গত কয়েক মাস ধরেই গজঘঅ (এম আরএনএ) ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ দেয়ার অনুমোদন দেয়ার জন্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এফডিএ) বিভিন্ন গবেষণামূলক তথ্য উপস্থাপন করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তারা বড় আকারের গবেষণার ফলাফলও প্রকাশ করেছে।
মডার্নার গবেষণায় দেখা যায়, যারা জুলাই ২০২০ থেকে অক্টোবর ২০২০ সময়ে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার ডিসেম্বর ২০২০-মার্চ ২০২১ সময়ে ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, যারা ছয় মাস আগে ভ্যাকসিন নিয়েছে তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার বেশি। এ থেকে তারা সন্দেহ প্রকাশ করছে যে, ওই ছয় মাসে তাদের এন্টিবডির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমেছে।
একইভাবে, ফাইজার গত জুলাই ২৮ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় যে, ফাইজারের ভ্যাকসিনের দু’টি ডোজ দেয়ার ছয় মাস পরে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৮ শতাংশ কমে যায়। এ ছাড়া ইসরাইল ও ইংল্যান্ডের পৃথক গবেষণায় সময়ের সাথে সাথে এ দু’টি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মডার্না ও ফাইজারের বিজ্ঞানীদের যুক্তি হচ্ছে, করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার প্রথম ছয় মাস ভ্যাকসিন কার্যকর হলেও এক বছর পর এটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাবে না। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব হওয়ার কারণে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, উপরোক্ত গবেষণার কার্যকারিতা কমে যাওয়া বলতে মূলত ভ্যাকসিন দেয়া ব্যক্তিতে করোনা লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া বোঝানো হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, বাজারে প্রচলিত মডার্না, ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ অন্যান্য করোনা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে গুরুতর করোনা রোধে অত্যন্ত কার্যকর।
এখন পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এফডিএ সম্প্রতি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা নাকচ করে দিয়েছে।
এফডিএর এমন সিদ্ধান্তের মূল কারণ হচ্ছে, ঈউঈ (ঈবহঃবৎং ভড়ৎ উরংবধংব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ চৎবাবহঃরড়হ) এর গবেষণা। সিডিসির সাম্প্রতিক গবেষণায় অনুযায়ী এ বছর ২ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৬৬ মিলিয়ন মানুষ করোনার দুই ডোজ সম্পন্ন করেছে। এদের মধ্যে সাত হাজার ১০১ জন (০.০০৫ শতাংশ) গুরুতর করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং এক হাজার ৫০৭ জন (০.০০১ শতাংশ) মৃত্যুবরণ করেছে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনা ভ্যাকসিনের দুই ডোজ গুরুতর করোনা প্রতিরোধে ৯৯.৯৯৯ শতাংশ কার্যকর।
করোনা টিকার ডোজ সম্পন্ন করার পরও যারা মারা গেল তাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্র্ধ্বে বা এমন কোনো ব্যক্তি যারা কোনো কারণে শরীরে পর্যাপ্ত এন্টিবডি তৈরি করতে পারে না (ওসসঁহড়পড়সঢ়ৎড়সরুবফ রহফরারফঁধষং, যাদের ড়ৎমধহ ঃৎধহংঢ়ষধহঃ হয়েছে)। এ জাতীয় রোগীর ক্ষেত্রে করোনা ঝুঁঁকি এড়াতে ঋউঅ ১২ আগস্ট গজঘঅ ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে।
এখানে সতর্ক থাকতে হবে যে, জনসন অ্যান্ড জনসন বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বুস্টার ডোজ প্রযোজ্য হবে না। কারণ এখন পর্যন্ত এসব ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ সংক্রান্ত কোনো গবেষণা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত ৬৫ বছরের ঊর্র্ধ্বে এবং ওসসঁহড়পড়সঢ়ৎড়সরুবফ প্রায় এক মিলিয়ন মানুষকে গজঘঅ ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে। ইসরাইলের একটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ বছর বয়সের ঊর্র্ধ্বে ব্যক্তিদের ফাইজারের তৃতীয় ডোজ দেয়ার পর করোনা ইনফেকশনের হার উল্লেøখযোগ্য হারে কমে গেছে।
সুতরাং, গজঘঅ ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ শুধু ৬০ বছরের বেশি মানুষের ক্ষেত্রে চিন্তা করা যেতে পারে।

তাহলে কি করোনা মহামারী শেষ হলো?
এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, এমন কোনো করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসবে না যার বিপরীতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কম পরিলক্ষিত হবে। এখানে উল্লেøখ করা প্রয়োজন, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট নামক নতুন ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে।
জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে ঞ৭৬ও ও খ৪৫২ছ জাতীয় দু’টি জীনগত পরিবর্তন থাকায় এটি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে বেশি সংক্রামক। এ ছাড়া ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে সাতটি এমাইনো এসিড ফবষবঃরড়হ পরিলক্ষিত হয়েছে যার কারণে এটি বর্তমানে প্রচলিত ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এন্টিবডিকে ফাঁকি দিয়ে শরীরে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি নিয়ে এখন বিস্তারিত গবেষণা চলছে। বিস্তারিত তথ্য জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই গবেষণার ফলাফল শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হলে আর ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে নতুন আরেকটি ডোজ (তৃতীয় ডোজ) নেয়ার সম্ভাবনার কথা উপেক্ষা করা যাবে না।
করোনা প্রতিরোধে এখন শুধু একটিই মন্ত্র : করোনা টিকা নিন নতুন ভেরিয়েন্টের আবির্ভাব বন্ধে সাহায্য করুন।

লেখক : স্টাফ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড ইমিউনোলজিস্ট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র

 


আরো সংবাদ



premium cement