২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঘাড় ব্যথার কারণ ও প্রতিকার

-

ঘাড় ব্যথা কখনো করেনি এমন মানুষ কম। কারণ আর কিছুই নয়, ঘুম। ঘুমের সময় আমরা যেমন পূর্ণ চেতন থাকি না, পুরো অচেতনও নয়। ঘুমের সময় শরীরে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে ঘাড়ে এবং পিঠে। শুধু কি ঘুম! একটু টেনশনে দিন কাটালে দিন শেষে ঘাড়ে ব্যথা করে। অনেকক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করলে ঘাড়ে ব্যথা করে। দীর্ঘদিন স্ট্রেস থাকলে মাথাসহ ঘাড় ব্যথা করে। কিছু রোগের কারণে ঘাড় ব্যথা করে প্রচণ্ড। তখন ঘাড় ব্যথার উপসর্গই হয়ে দাঁড়ায় মরণঘাতী রোগটি চিহ্নিতকরণের প্রধান সিম্পটম। যেমন মেনিনজাইটিস। ঘাড়ে আঘাত পাওয়া থেকে, মাসল কিংবা হাড়ের ইনজুরি, স্টিফ নেক সমস্যা থেকে বয়স ভেদে ঘাড় ব্যথার উপসর্গ, আর্থ্রাইটিস থেকে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, এমন অনেক কারণেই ঘাড় ব্যথা করতে পারে।
ষ নেক বা ঘাড়ের অংশে ব্যথা করাই নেক পেইন বা ঘাড় ব্যথা। ঘাড় মানে মাথার নিচ থেকে পিঠ বা বুকের শুরুর আগ পর্যন্ত অংশটি। এটির কাজ মাথাকে বহন করা, মাথার সাথে শরীরের উপরের অংশের সমন্বয় করা। তাই সারা দিন যতক্ষণ জেগে থাকে শরীর, ততক্ষণ এই ঘাড়কে মাথার সাথে, শরীরের সাথে, হাতের সাথে, এমনকি পায়ের সাথে ঘুরতে হয়। ঘাড়কে সবচেয়ে বেশি একটিভ থাকতে হয় চোখের সাথে। বলা হয় চোখ যে দিকে যায়, ঘাড় সে দিকে ধায়। এই ঘাড়ে থাকে পেশি, হাড়, লিগামেন্ট, স্পাইনাল কর্ড, কিছু গ্ল্যান্ড, সফট টিস্যু। শরীরের এই অংশের ওজন গড়ে পাঁচ থেকে ছয় কিলোগ্রাম!
ষ ঘাড়ে আছে ২৬টি পেশি, যার বেশির ভাগ শরীরের দুই পাশে জোড়ায়। ঘাড়ে থাকে সাতটি হাড়। ঘাড়ের উপরে থাকে মস্তিষ্কের খুলি এবং নিচে থাকে বুকের খাঁজের হাড়, সামনে এবং পেছনে পিঠের হাড়। শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপ্তপূর্ণ হাড়গুলোকে সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে এই ঘাড়। তাই ঘাড়ের ওপর অনেক চাপ।
ষ ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ ঘাড়ে ব্যথা, হঠাৎ শরীরে জ্বরের সাথে ঘাড়ে ব্যথা, দিনের শেষে বা সকালে কোনো কারণ ছাড়াই কাঁধের সাথে ঘাড়ে ব্যথা, ভারী কোনো জিনিস তুলতে গিয়ে ঘাড়ে মোচড় খেয়ে পরদিন ঘাড় ব্যথা, এমন অনেক কারণে ঘাড় ব্যথা হলে তার প্রধান উপসর্গ সাথে মাথা, পিঠ বা কাঁধে ব্যথা, ঘাড় নাড়াতে না পারা, নাড়ালেই ব্যথা করা, ঘাড়ের মাসল স্টিফ বা শক্ত হয়ে যাওয়া, গলায় কোনো কারণে ব্যথা করা, গলা ফুলে যাওয়া, ঘাড়ে স্পাজম হওয়া।
ষ অনেকক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহার করলে অথবা দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোনে তাকিয়ে থাকলে ঘাড়ের মাসল, বোন, লিগামেন্ট, স্পাইন, এমনকি পিঠ এবং কাঁধের ওপর চাপ পড়ে। আর তাতে অনেকের দিনের পর দিন কিছুটা সময় ঘাড় ব্যথা করে। নিয়ম হলো একনাগাড়ে ২০ মিনিটের বেশি কম্পিউটার হোক, মোবাইল ফোন হোক, বই পড়া হোক, এমনকি নরমাল পড়াশোনা কিংবা অফিসের কাজ হোক, করা উচিত নয়। প্রতি ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর ঘাড়কে এবং সাথে চোখকে বিশ্রাম দেয়া উচিত। তিন থেকে পাঁচ মিনিট ঘাড় নরমাল পজিশনে রেখে রিলাক্স করলে, স্ট্রেচ করলে, সামনে-পিছে মুভ করলে, ল্যাটেরাল এক্সারসাইজ করে নিলে ঘাড়ে আর তেমন ব্যথা করবে না।
ষ এক কাঁধে দীর্ঘক্ষণ কোনো ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখলে ঘাড়ে ব্যথা করে। রাতে দাঁত কিড়মিড় করা লোকেরা সকালে ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করে। ভুল বালিশে কিংবা ভুল পজিশনে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে ঘাড় ব্যথা করে। আর্থ্রাইটিস রোগীরা সময় সময় ঘুম থেকে উঠেই ঘাড় ব্যথা অনুভব করে। ঘাড়ের জায়গায় কোনো ইনফেকশন হলে, ঘাড়ের হাড়ে কোনো আঘাত পেলে, ঘাড়ের স্পাইনাল কর্ডে কোনো ইনজুরি হলে, ঘাড়ের মেরুদণ্ডের হাড় কোনো কারণে স্লিপ করলে, ঘাড়ের কোনো নার্ভ ইনজুরি হলে, ঘাড়ে কোনো টিউমার হলে, ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
ষ স্পোর্টস, রোড এক্সিডেন্ট কিংবা কোথাও থেকে পড়ে গেলে ঘাড়ের এলাকায় স্ট্রেইন বা ¯েপ্রইন হলে ঘাড়ের মেরুদণ্ডের হাড়, নার্ভ, মাসল, জয়েন্ট, লিগামেন্টের একটি কমন ইনজুরি হয়। একে বলে হুইপ্ল্যাশ। হঠাৎ ঘাড়ের অংশে প্রবল জার্কিং হলে সবগুলো অংশে কম বেশি ইনজুরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ঘাড়কে কোনোভাবে না নাড়িয়ে কিছু দিয়ে ঘাড়কে সোজা রেখে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবেন দ্রুত।
ষ অনেকের ব্যায়ামের সময় বিশেষ করে ওয়েট লিফটিংয়ে কোমরের সাথে ঘাড়ের ইনজুরি হতে পারে শরীরের কোনো ভুল মুভমেন্ট অথবা ঝাঁকুনিতে।
ষ মেনিনজাইটিস এবং হার্ট অ্যাটাক হলে প্রচণ্ড ঘাড় ব্যথা করতে পারে। সাথে মাথা ব্যথা, বমি হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, শরীরে টেম্পারেচার বেড়ে যেতে পারে।
ষ অস্টিওপোরেসিস, ফাইব্রোমায়ালজিয়া, স্পন্ডাইলাইটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, সারভাইক্যাল হার্নিয়েটেড ডিস্ক, স্পাইনাল স্টেনোসিস এমনসব রোগে ঘাড় ব্যথা কমন সিম্পটম।
ষ ঘাড় ব্যথা হলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। প্রথমে ঘাড়কে কিছুক্ষণ স্ট্রেচ করে নিলে, ঘাড়ের কিছু ব্যায়াম এবং ম্যাসেজ করে নিলে, কিছু সময়ের পর চলে যাবে। তাতে না গেলে বা দীর্ঘক্ষণ ঘাড়ে ব্যথা করলে হিট প্যাড ব্যবহার করতে পারেন। ঘাড়ে কাপড় দিয়ে গরম সেঁক দেয়া। তাতে না কমলে ব্যথানাশক কিংবা মাসল রিলাক্সেন্ট কোনো ক্রিম লাগাতে পারেন ঘাড়ে। ঘাড়ে কোনো ইনজুরি হলে সঙ্গে আইস প্যাক দিয়ে জায়গাটি ম্যাসেজ করবেন।
ষ যেকোনো ঘাড় ব্যথার ক্ষেত্রে হিট অ্যান্ড কোল্ড থেরাপির কম্বিনেশন ভালো। ঘাড়ে ব্যথা করলে শুরুতে কোনো কাপড় দিয়ে জায়গাটিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট গরম সেঁক দেয়। ঘণ্টাখানেক পর কিছু বরফ টুকরো একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ঘাড়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে রাখা। দিনে এমন কয়েকবার করলে ঘাড় ব্যথা কমে যাবে।
ষ দিন শেষে এমন সব হোম ট্রিটমেন্টের পরে ঘাড় ব্যথা থেকে গেলে রাতে ঘুমের আগে ভরা পেটে একটি বা দুটি প্যারাসিটামল কিংবা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খেয়ে নিতে পারেন। সাথে বেশি পরিমাণ পানি পান করবেন।
ষ এক নাগাড়ে সাত দিনের বেশি এমন ঘাড় ব্যথা থাকলে কিংবা ঘরোয়া ট্রিটমেন্টের পর চলে না গেলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
ষ ঘাড়ের এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক রক্তের রুটিন টেস্ট, ঘাড়ের এক্স-রে, করে দেখবেন। শরীর আরো খারাপ হলে বা কোনো দুর্ঘটনা হলে দরকার পড়লে এমআরআই, সিটি স্ক্যান করতে দেবেন। মেনিনজাইটিস হলে লাম্বার পাংচার টেস্ট করতে দেবেন।
ষ ঘাড়ের কিছু ব্যায়াম, ম্যাসেজ, ফিজিওথেরাপি, ট্রাকশন, কলার সাপোর্ট, কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন, পেইন কিলার ট্যাবলেট, ক্যাপসুল কিংবা সাপোজিটোর, ইনফেকশন হলে এন্টিবায়োটিক এবং উপরের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে ঘাড়ের কিছু সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসার চেষ্টা করবেন।
ষ অল্টারনেটিভ টিটমেন্ট হিসেবে আকুপাংচার, ঘাড়ের ইয়োগা, চিরোপ্রাকটিক ট্রিটমেন্ট অথবা ট্রান্সকিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক নার্ভ স্টিমুলেশন জাতীয় ট্রিটমেন্ট আছে।
ড়ঢ়ঁৎনড়.পযড়ফিযঁৎু@মসধরষ.পড়স
কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক , লন্ডন, ইংল্যান্ড


আরো সংবাদ



premium cement