২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
অক্সফোর্ড ও ফাইজার ভ্যাকসিন

করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে জীবন বাঁচায়

-

বাংলাদেশে করোনা মহামারীর তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। দেশের সীমান্ত ঘেঁষা উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চচলের জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার এখন ৩০-৬৫ শতাংশ। এই সংক্রমণের ৮৫ ভাগই হচ্ছে ভারতের অতিসংক্রামক ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ দিয়ে। এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে। আইসিডিডিআরবির জিনোম সিকুয়েন্সিং ডাটা অনুযায়ী ঢাকায় এখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি ৬৮ শতাংশ। গোটা দেশে গতকাল সোমবার সংক্রমণের হার ছিল ১৯ শতাংশের ওপরে।
এমতাবস্থায়, একটি প্রশ্ন এখন সবার মনেই। তা হলো, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কি করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে কার্যকর? দেশে যারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) নিয়েছেন তারা কি এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত?
যুক্তরাজ্যেও এই প্রশ্নটি এখন সরকারসহ সবার মনে। দেশটি বর্তমানে তৃতীয় ঢেউয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই তৃতীয় ঢেউয়ের ৯০ শতাংশ সংক্রমণই হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। যুক্তরাজ্যে এখন করোনার প্রধান ভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে ইন্ডিয়ার ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’। দেশটিতে প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষকে কোভিড ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ দেয়া হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি হচ্ছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন এবং বাকিটা ফাইজার ও মর্ডানা। শুধু ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করেই জুলাইয়ের ১৭ তারিখে দেশটির লকডাউন সম্পূর্ণরূপে শিথিল করা হবে।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ১৪ হাজার রোগীর ওপর। এই গবেষণার ফলাফলটি প্রকাশিত হয়েছে ১৪ জুন তাদের ওয়েবসাইটের একটি প্রি-প্রিন্টে। এতে দেখা যায় যে, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ যারা নিয়েছেন তাদের ৯২ শতাংশই কোনো প্রকার মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হননি বা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হননি। আর যারা ভ্যাকসিনটির একটি ডোজ নিয়েছেন তাদের ৭১ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
ফাইজার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ফলাফল দেখা গেছে। অর্থাৎ যারা ফাইজারের দুটো ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের ৯৬ শতাংশ মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর যারা একটি ডোজ নিয়েছেন তাদের ভেতরে ৯৪ শতাংশ মারাত্মক কোভিড থেকে মুক্ত ছিলেন।
এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ১৪ হাজার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যে ১৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তাদের কেউই কোভিডে মারা যায়নি। অর্থাৎ অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিন কোভিড থেকে মৃত্যু রোধ করেছে শতভাগ। তবে, পাবলিক হেল্থ ইংল্যান্ডের ভ্যাষ্য মতে ভবিষ্যতে মৃত্যু প্রতিরোধের পরিসংখানটিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে।
এই ‘রিয়েল লাইফ এভিডেন্স’ থেকে এটা নিশ্চিত যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ফাইজার ভ্যাকসিনের দুইটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংঘটিত মারাত্মক বা সিভিয়ার কোভিড থেকে সুরক্ষা দেয় গড়ে ৯৪ শতাংশ। আর যারা ভ্যাকসিনের একটি ডোজ নিয়েছেন, তারা মারাত্মক কোভিড থেকে রক্ষা পাবেন ৭৫ শতাংশ।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়। তা হলো, ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নেয়ার পরও কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রায় ২০-৪০ শতাংশ। ২৪ মে মেড-আর্কাইভে প্রকাশিত পাবলিক হেল্থ ইংল্যান্ডের আরেকটি গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায় যে অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংঘটিত কোভিড প্রতিরোধে কার্যকরি মাত্র ৩৩ শতাংশ। তবে, অক্সফোর্ড বা ফাইজারের দুই ডোজ টিকা এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয় যথাক্রমে ৬০ এবং ৮১ শতাংশ।
সুতরাং, পাবলিক হেল্থ ইংল্যান্ডের ওপরের দুটো স্টাডি থেকে এটা পরিষ্কার যে ভ্যাকসিন নেয়ার পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হলেও তা থেকে মারাত্মক কোভিড বা মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যায় প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর যারা ভ্যাকসিনের একটি ডোজ নিয়েছেন তারা মারাত্মক কোভিড থেকে ৭৫ শতাংশ মুক্ত।
অতএব, বাংলাদেশে যারা ভ্যাকসিন নেয়ার পরও এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময় আক্রান্ত হচ্ছেন বা হবেন তাদের ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ, যারা আক্রান্ত হবেন তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কোভিড থেকে সেরে উঠবেন আশা করা যায়।
কোভিড মহামারীতে জীবন রক্ষায় ভ্যাকসিনের ভূমিকা অপরিহার্য। এটা আর এখন কোনো তত্ত্বগত বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা নয়। এটা এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা প্রমাণিত হয়েছে অক্সফোর্ড এবং ফাইজার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে। তবে একই ফল হয়তো দেখা যাবে চীনের সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও। কারণ সব ভ্যাকসিনের মূলনীতি একই- দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে প্রশিক্ষিত করা। চীন বা রাশিয়ার ভ্যাকসিনও দেহে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যতগুলো ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সবই কার্যকর ভ্যাকসিন।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাংলাদেশে গণটিকা কার্যক্রমের সূচনা ভালো হলেও এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের একটি ডোজ দেয়া সম্ভব হয়েছে, যেখানে এই সংখ্যাটি ভারতের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ এবং নেপালের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ। এই সংখ্যাটি যত দিন পর্যন্ত ৬০-৭০ শতাংশে না উন্নীত করা যাবে তত দিন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের সুফল পাওয়া যাবে না। মহামারী থেকে বেড় হয়ে আসার এখন একটিই রাস্তা। আর তা হলো দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোভিড ভ্যাকসিনের আওতায় আনা।
লেখক : এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য


আরো সংবাদ



premium cement