২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শীতের সবজিতে সতেজ দৃষ্টি

-

দৃষ্টি মানুষের অমূল্য সম্পদ। দৃষ্টিহীন মানুষের কাছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য অর্থহীন। দৃষ্টিহীন মানুষের পক্ষে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন করা দুরূহ। অমূল্য সম্পদ এই দৃষ্টিকে সাড়া জীবন ধরে রাখাও এক কঠিন বিষয়। জন্ম থেকে মৃত্যু এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিকে যেতে হয়। বিভিন্ন রকমের অসুস্থতায় দৃষ্টিশক্তি ক্ষয় হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে কোনো ধরনের অসুস্থতা ছাড়াই দৃষ্টিশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে বার্ধক্য নিজেই এমন একটি বিষয় যেখানে দৃষ্টিশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। দৃষ্টিশক্তির সাথে খাদ্যাভ্যাসের আছে নিবিড় সম্পর্ক। কিছু কিছু খাদ্য উপাদান আছে যেগুলো দৃষ্টিকে সারা জীবন সতেজ রাখতে সাহায্য করে। এমনকি বার্ধক্যজনিত দৃষ্টিক্ষয়প্রাপ্ত হওয়াকেও অনেকখানি ঠেকিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ অসুস্থতা, বার্ধক্য ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা না গেলেও কেবল খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে দৃষ্টিশক্তি অনেকটাই সতেজ রাখা সম্ভব। বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে দৃষ্টিশক্তি কী এবং খাদ্য উপাদান কিভাবে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করে তা আমাদের বুঝতে হবে।
দৃষ্টিশক্তির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত অঙ্গ হলো চোখ। চোখের আকৃতি অনেকটা গোলাকৃতি যার ভিতরটা ফাঁকা ও বিশেষ এক ধরনের তরল পদার্থ দ্বারা পূর্ণ এবং বাইরের দিকটি তিন স্তরবিশিষ্ট আবরণে আবৃত। বাইরের স্তরটি তুলনামূলক শক্ত এবং এর সামনের দিকের কালো অংশে বিস্তৃত অংশটিকে কর্নিয়া এবং পেছন দিকের সাদা অংশটিকে স্কেলেরা বলা হয়। তার পরের স্তরটি হলো রক্তনালীর স্তর বা ইউভিয়াল ট্রেক্ট এবং সব থেকে ভিতরের স্তরটি হলো স্নায়ুর স্তর যাকে বলা হয় রেটিনা। এই রেটিনা হলো আলোক সংবেদনশীল স্তর। চোখের ভিতর আপতিত আলোকরশ্মি রেটিনার সংস্পর্শে এলে রেটিনা উজ্জীবিত হয় এবং এক ধরনের সিগন্যাল বা বার্তা তৈরি করে যা মস্তিষ্কের সাথে চোখের সংযোগকারী অপ্টিক নার্ভ নামক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে আমাদের দেখতে সাহায্য করে। পুড়ো বিষয়টি যতটা সহজ মনে হচ্ছে তা আসলে ততটা সহজ নয়।
এখানে মূল বিষয়টি হলো আলোর সাথে রেটিনার মিথষ্ক্রিয়া যা আলোক শক্তিকে ইলেকট্রিক্যাল বা তড়িৎশক্তিতে রূপান্তর করে। রেটিনাতে আলোকশক্তির তড়িৎশক্তিতে রূপান্তর হওয়ার এই মিথষ্ক্রিয়াকে বলা হয় ফটোকেমিক্যাল রিয়েকশন। রেটিনাতে বিশেষ ধরনের আলোক সংবেদনশীল কোষ আছে যাদের বলা হয় ফটোরিসেপ্টর। দুই ধরনের ফটোরিসেপ্টর বিদ্যমান। দিনের আলো বা উজ্জ্বল আলোতে কাজ করতে সক্ষম রিসেপ্টরটিকে বলা হয় কোণ রিসেপ্টর। আর কম আলো বা রাতের বেলায় সক্ষম রিসেপ্টরকে বলা হয় রড রিসেপ্টর। রড রিসেপ্টর অধিকতর আলোক সংবেদনশীল এবং সংখ্যায়ও অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। রড রিসেপ্টরটি আসলে অপসিন নামক আমিষ বা প্রোটিন কণা এবং ভিটামিন এ-র সক্রিয় কণা বা রেটিনাল এর সমন্বয়ে গড়া একটি বিশেষ যৌগ। আলোকরশ্মি রেটিনাকে উজ্জীবিত করার অর্থ হলো এই সক্রিয় ভিটামিন এ বা রেটিনালকে উজ্জীবিত করা। রেটিনালকে উজ্জীবিত করতে প্রচুর অক্সিজেন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক দিকে আলোকরশ্মি এবং অন্য দিকে ভিটামিন এ এবং অক্সিজেনের এই মিথষ্ক্রিয়ার ফলে আলোকশক্তি তড়িৎশক্তিতে রূপান্তর হয়। এটিই হলো প্রধান বার্তা যেটি চোখ থেকে অপ্টিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে ইমেজ তৈরি করে এবং আমরা দেখতে পাই। এখানে এই ফটোকেমিক্যাল রি-অ্যাকশনে সাড়া দিন প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে কিছু বর্জ্য তৈরি হয়। এদের বলা হয় ফ্রি রেডিক্যাল। যেমনÑ সিঙ্গেল অক্সিজেন, হাইড্রোক্সিল আয়ন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ইত্যাদি। স্নায়ুতে এদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থাৎ দ্রুত অপসারিত না হলে চোখের আলোক সংবেদনশীল কোষ বা ফটোরিসেপ্টর ধীরলয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এক সময় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্ধত্বের সৃষ্টি করে থাকে। অক্সিজেন ব্যবহারে তৈরি বর্জ্য বা ফ্রি রেডিক্যালের মাধ্যমে এই ক্ষয় প্রক্রিয়াকে বলা হয় অক্সিডেটিভ স্ট্রেস। মস্তিষ্ক ও চোখের স্নায়ু অধিকতর অক্সিজেন ব্যবহার করে বিধায় এই দুটি অঙ্গ বিশেষভাবে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের ঝুঁকিতে থাকে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেসে উৎপাদিত ফ্রি রেডিক্যাল তার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতে স্নায়ুর যে ক্ষতি করে তা দেহ খুব সহজেই সারিয়ে নিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, লিউটিন, জিংক ইত্যাদি যৌগ খুব দ্রুত উক্ত ফ্রি রেডিক্যালকে নিষ্ক্রিয় করে দেহ থেকে অপসারণে সাহায্য করে থাকে। এই যৌগগুলোকে একসাথে বলা হয় এন্টিঅক্সিডেন্ট। দেহের অন্যান্য অংশেও এন্টিঅক্সিডেন্ট একই রকম ক্ষয়রোধী ভূমিকা রাখে। এন্টিঅক্সিডেন্টের অভাবে ফ্রি রেডিক্যাল চোখের স্নায়ুতে বা ফটোরিসেপ্টরে প্রতিনিয়ত যে ক্ষত চিহ্ন রেখে যায় তাই একসময় রেটিনার মেকুলাতে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে। এটিকে বলা হয় মেকুলার ডিজেনারেশন যা পরিণত বয়সে অর্থাৎ বার্ধক্যে মারাত্মক দৃষ্টি সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেকেই ৫০ বা ৬০ বছর বয়সেই পড়াশোনা করার মতো প্রয়োজনীয় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। পড়াশোনা বা সূক্ষ্ম কাজে অক্ষম হওয়ার পাশাপাশি একসময় স্বাভাবিক কাজে অক্ষম হয়ে পড়ে এমনকি একসময় স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করার মতো দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলে।
তাই এটি খুবই সঙ্গত দৃষ্টিশক্তিকে সতেজ রাখতে এবং বয়সকালে পড়াশোনা ও স্বাভাবিক কাজকর্ম ও চলাফেরা করার মতো প্রয়োজনীয় কাজের সক্ষমতা ধরে রাখতে এন্টিঅক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার যেমন ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই; লিউটিন, জিংক, জিজেনথিন সমৃদ্ধ খাবারগুলোকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। ভিটামিন এ প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান পালং শাক, লেটুস পাতা, গাজর, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদিতে। টমেটো, কমলা, লেবু ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে ভোজ্যতেল, বাদাম, ছোলা, পালং শাক ও মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি। লিউটিন ও জিজেনথিন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে পালং শাক, লেটুস পাতা, গাজর, কমলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি।
অক্সিডেটিভ স্ট্রেসজনিত চোখের স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষত এড়াতে প্রয়োজনীয় এন্টিঅক্সিডেন্ট সংবলিত খাবারগুলো সাধারণত সবুজ শাকসবজিতে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। আমাদের শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে এসব শাকসবজি পাওয়া যায়। দামেও বেশ সাশ্রয়ী। চোখের যতেœ বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি সতেজ রাখতে দৈনন্দিন খাবারের সাথে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি গ্রহণ করা উচিত। অনেক সময় একই সবজিতে বিভিন্ন রকম এন্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান থাকে এবং একাধিক এন্টিঅক্সিডেন্ট যখন একই সাথে আমরা গ্রহণ করি তখন এর কার্যকারিতা বেশি পাওয়া যায়। আবার এন্টিঅক্সিডেন্টের চাহিদা পূরণে এন্টিঅক্সিডেন্ট সাপ্লিমেন্ট বা ক্যাপসুল ট্যাবলেট ইত্যাদি গ্রহণ করার চেয়ে শাকসবজি গ্রহণ করা অধিকতর উপকারী। তাই সারা জীবন দৃষ্টি সতেজ রাখতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
লেখক : চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন; কনসাল্ট্যান্ট, আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার
৩৮/৩-৪ রিং রোড, শ্যামলী, আদাবর, ঢাকা।
ফোন : ০১৯২০৯৬২৫১২

 


আরো সংবাদ



premium cement