২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্ট্রোকে করণীয়

-


বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, ব্লাড প্রেসার বাড়তে বাড়তে রক্তনালীগুলো একসময় বেলুনের মতো ফেটে যায়, যার নাম দেয়া হয়েছে স্ট্রোক। আসলে একেবারেই তা না। ৮৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রক্তনালী সরু অথবা বন্ধ (ব্লক) হয়ে যায়। ফলে এই রক্তনালীটি যে অঞ্চলে রক্ত সরবরাহ করার কথা ছিল সেখানকার কোষগুলো অক্সিজেন ও গ্লুকোজের অভাবে মরে যেতে থাকে। এরকম ঘটনা যদি ব্রেইনের বেলায় ঘটে তাহলে তাকে বলে স্ট্রোক, আর হার্টের বেলায় হলে তা হার্ট অ্যাটাক।

রক্তনালী কেন সরু বা বন্ধ হয়ে আসে?
রক্তনালীর ভিতরে চর্বি জাতীয় জিনিস জমে। এটা জমে অনেক মাস বা বছর ধরে। কেন জমে তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে অনেক রিস্ক ফ্যাক্টরকে এর জন্য দায়ী করা হয়। যেমনÑ বার্ধক্য, পুরুষ হয়ে জন্মানো, ধূমপান করা, শারীরিক পরিশ্রম না করা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যালকোহল ইত্যাদি। কিন্তু ডাক্তাররা যতভাবেই বলুন, মিডিয়া যতভাবেই প্রচার করুক, আমাদের রোগীরা কেবল উচ্চ রক্তচাপটাকেই রিস্ক হিসেবে মানতে রাজি। কারণ বাকিগুলো তথাকথিত বেলুন থিওরি দিয়ে মেলানো যায় না।
আসুন আমরা ধূমপান, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপÑ এই তিনটি রিস্ক ফ্যাক্টরকে তুলনা করি। স্ট্রোকের রিস্ক হিসেবে এ তিনটি প্রায় সমান। কোনো ধূমপায়ী যদি ধূমপান ছেড়ে দেন তাহলে প্রথম বছরে রিস্ক কমে যায় ৫০ শতাংশ। পাঁচ বছর পরে ধূমপানের জন্য আর কোনো রিস্কই অবশিষ্ট থাকে না।
কারো যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে আর তার চিকিৎসা করা না হয়, কয়েক বছর পর তার স্ট্রোক হতে পারে। আবার কোনো দিন না-ও হতে পারে। কিন্তু স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হলে এই সম্ভাবনা কমে যায় ৪০ শতাংশ।
যিনি প্রতিদিন দু’চারবার করে ব্লাড প্রেসার মাপেন, তাকে যদি বলা হয় আপনি এখন থেকে আর সিগারেট খাবেন না। তিনি বেশ একটা হাসি দিয়ে বলবেন, দিনে দু’চারটা খাই, কিছু হবে না। অথচ রিস্কের বিবেচনায় ধূমপান ছেড়ে দেয়া উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করার চেয়েও বেশি লাভজনক।
স্ট্রোকের রিস্ক হিসেবে ডায়াবেটিসের গুরুত্ব উচ্চ রক্তচাপের প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু আমি গত ১০ বছরে এরকম কারো সন্ধান পাইনি যিনি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলেছেন, আমার ব্লাড সুগার বেশি, তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দেন, না হলে স্ট্রোক হয়ে যাবে। প্রেসারের জন্য এমন অনেকেই এসেছেন।
এরকম অনেক রোগী আছেন যারা বাসায় ডিজিটাল প্রেসার মেশিন রাখেন। ব্লাড প্রেসার না মেপে সকাল বেলা অন্ন স্পর্শ করেন না। আর একবার প্রেসার চেক না করে ঘুমাতে যান না। অথচ ব্লাড সুগার থাকে সবসময়ই বেশি। এরকম রোগীকে যদি বলা হয়, আপনার সুগার তো বেশি। খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেন, ব্যায়াম করেন। তিনি বলবেন, কই আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কখনো কখনো আমি বলি, কী সমস্যা হলে তারপর সুগার নিয়ন্ত্রণ করবেন? স্ট্রোক হলে? হার্ট অ্যাটাক হলে নাকি কিডনি তার কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে?
স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে উচ্চ রক্তচাপের কথা সবাই জানেন এবং মানেন। ক্যান্সারের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে ধূমপানের যতটা পরিচিতি আছে স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে ততটা নেই। আর ডায়াবেটিসের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে সবাই যতটা তৎপর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার বেলায় ততটা নয়।
স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের কিছু কোষ মরে যায়। যেগুলো মরে যায় সেগুলো আর কোনো দিনই ফেরত আসে না। তাহলে আমরা চিকিৎসা করি কেন?
চিকিৎসার প্রথম উদ্দেশ্য হলো কোষগুলোকে মরতে না দেয়া। এর জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিট ও স্ট্রোক ফিজিসিয়ান। এ কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। তবে এ চিকিৎসা নিতে হলে রোগীকে স্ট্রোক ইউনিটে পৌঁছতে হবে স্ট্রোক হওয়ার তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে।
এ ছাড়া যে কোষগুলো মরে যায় তার চারপাশে থাকে কিছু আহত বা আধামরা কোষ। এগুলোর কিছু কিছু এমনিতেই সুস্থ হয়ে ওঠে। এ কারণেই চিকিৎসা না করলে বা কবিরাজি করলে স্ট্রোকের রোগী কিছুটা ভালো হয়। চিকিৎসার আরেকটা উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ স্বাভাবিক নিয়মের চেয়ে বেশি পরিমাণ কোষকে বাঁচিয়ে তোলা। এর জন্য প্রয়োজন রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে সে অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা নেয়া। এগুলো স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
এই চিকিৎসাগুলো স্ট্রোক হওয়ার সাথে সাথে করতে হয়।
এছাড়া স্ট্রোকের রোগীকে কিছু চিকিৎসা সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয়। প্রথমত, যা কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে তা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলা। দ্বিতীয়ত, আবার যাতে স্ট্রোক না হয় তার জন্য কিছু ওষুধ খাওয়া। তৃতীয়ত, বিশেষ কিছু ব্যায়াম।
রিস্ক ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ধূমপান ছেড়ে দেয়া, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মিত হাঁটা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি। কিছু ওষুধ নিয়মিত খেতে থাকলে পরবর্তীতে আবারো স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে আসে। এগুলো খেতে হয় অনির্দিষ্টকাল ধরে। অনেক রোগী আছেন যারা ছয় মাস বা এক বছর ওষুধ খেয়ে বলেন, ওষুধ খেয়ে তো কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তারপর ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। মনে রাখা দরকার, ওষুধ খাওয়ার উদ্দেশ্য অসুখ ভালো হওয়া নয়, বরং পরবর্তী অ্যাটাক প্রতিরোধ করা। অসুখ ভালো হওয়ার জন্য প্রয়োজন ব্যায়াম।
স্ট্রোকের ফলে যে কোষগুলো মরে যায় তা আর ফিরে আসে না। তবে মস্তিষ্কের অন্য কোষগুলো এদের কাজ শিখে নিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন অবিরাম প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার উপায় হচ্ছে বিশেষায়িত ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপি। অনির্দিষ্টকালের জন্য এসব ব্যায়াম চালিয়ে যেতে হয়। এর জন্য অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন।
প্রতি ১০০ জন রোগীর মধ্যে ২০ জন সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান একমাসের মধ্যে। যারা বেঁচে থাকেন তাদের প্রায় অর্ধেক রোগী একেবারেই ভালো হয়ে যান। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি ভুলেই যান যে তার একসময় স্ট্রোক হয়েছিল। বাকিরা কিছু না কিছু পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকেন।
লেখক : কনসালটেন্ট (মেডিসিন),
সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement