২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ আহার

-

নিরাপদ খাদ্য বা খাদ্য নিরাপত্তা যে নামেই আমরা একে অভিহিত করি দেহের সুস্বাস্থ্য, দেহকে নিরোগ ও সবল রাখার জন্য বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে খাবার খাচ্ছেন এটি যাতে সংক্রমিত না হয় সে দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। সে জন্য যে সময় খাবার কিনবেন সে সময় থেকে শুরু করে আহার করা পর্যন্ত সময়ের
পুরোটাই খাবার যাতে নিরাপদ থাকে সে দিকে নজর রাখতে হবে। লিখেছেন ডা: শুভাগত চৌধুরী

ঘরের বাইরে খাবার কিনে খাওয়া বিরাট ঝুঁকি ও ঝক্কির ব্যাপার। ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে (ইটের ওপর বসতি যেসব পথের পাশের রেস্তোরাঁ এদের ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ বলে ডাকতে অভ্যস্ত অনেকে শ্রমজীবী কম আয়ের মানুষের আহারের উৎস) কাচঘেরা রেস্তোরাঁ পর্যন্ত কোথাও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কেউ সজাগ বা একে পালন করেন এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তিনতারা-পাঁচতারা হোটেলে হয়তো খাদ্যের মানও নিরাপত্তা রাখতে হয়, কিন্তু সেসব হোটেলে খাদ্য গ্রহণ কেবল ভাগ্যবানরা করেন, আমজনতার ধারেকাছেও নেই। তাই গামছা বা বড় রুমালে চিঁড়া, মুড়ি, খই ও গুড় বেঁধে এবং পানির বোতল কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরোনো শ্রেয়। প্রয়োজনে কেউ রুটি, টোস্ট, বিস্কিট, সিদ্ধ ডিম, কলা বা ধোয়া বিভিন্ন ফল (আপেল-কমলা) সাথে নিতে পারেন ঘরের বাইরে ক্ষুধা পেলে বৃক্ষ ছায়াতলে বসে উদরপূর্তির জন্য। উন্নত দেশে দেখেছি কেউ নিরাপদ নয় এমন খাদ্য বিক্রি করতেই পারেন না আইন ও তত্ত্বাবধান এত কড়া। যারা আইন প্রয়োগ করবেন, এদের অনেকেই বিদেশ ভ্রমণ করে দেখে এসেছেন কী করে আইন প্রয়োগ করতে হয় এবং আইন প্রয়োগকে সফল করতে হলে কী কী আয়োজন বা পূর্বশর্ত পূরণ প্রয়োজন তা তারা জানেন। তাই এ বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
ঘরে বসে খাবার খেতে হলেও অনেক সতর্কতা প্রয়োজন। আমি এখন সেই প্রসঙ্গে আসছি।
বোতলজাত খাদ্য
অনেক বোতলজাত খাদ্যে এডিটিভ থাকে। নজর করবেন কী আছে। সবার জন্য তা উপযোগী না-ও হতে পারে।
খাদ্যে জীবাণু সংক্রমণ
মালমোনেলা, লিস্টারিয়া ও ক্যাম্পাইলোব্যাকটার জীবাণু ফুড পয়জনিং করতে পারে একে একিউট গ্যাস্ট্রোএন্টাবাইটিসও বলা যেতে পারে। এসব জীবাণুকে চোখে দেখা যায় না। ২০ মিনিটে এরা দ্বিগুণ হয়ে উঠতে পারে। ৭ ঘণ্টায় একটি জীবাণু বেড়ে হতে পারে ১০ লাখ।
একটি প্রাণসংহারী ফুড পয়জনিং হলো বটুলিজম। যাদের আক্রমণ করে, তাদের দুই-তৃতীয়াংশেরই প্রাণনাশ ঘটে যেতে পারে। বিষাক্ত খাদ্য খাওয়ার ১২-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হয় বমি। বিশেষ সন্দেহজনক খাদ্য হলো ঘরে তৈরি সংরক্ষিত খাওয়ার (যেমন: আচার, জ্যাম ও জেলি) নোনা মাছ, ঘরে তৈরি পনির। দৃষ্টি ঝাপসা হলে, দেহ টলমল করলে, চিবাতে ও গিলতে কষ্ট হলে, কথা বলতে ও শ্বাস নিতে কষ্ট হলে, উদ্বেগ ও শঙ্কার কারণ ঘটে। অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। যে খাবার খেয়ে এমন হয়েছে সন্দেহ, তা-ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভালো। জীবাণুঘটিত সংক্রামক রোগগুলো হলো টাইফয়েড, আমাশয় ও কলেরা।
টিনজাত খাবার
টিনের ঢাকনা মুছে, সতর্কতার সাথে খুলুন। খোলা ক্যানে খাবার রেখে দেবেন না। ফ্রিজে ঢাকনা ঢাকা দিয়ে রাখুন, দু’দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলুন। খালি ক্যান ফেলে দিন নিরাপদে। ব্যবহারের পর ক্যান ওপেনার ধুয়ে রাখুন।
ড্রেন নালা ও পয়ঃনালা
প্রতিবার ব্যবহারের পর ড্রেনের মুখের মধ্য দিয়ে গরম পানি ঢেলে ড্রেনকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখুন। রান্নাঘরের ড্রেনে সবজি, শাক বা তেল ছাড়বেন না। ড্রেনের মুখে একটি নেট বা জালি দেবেন যাতে খাদ্যের বর্জ্য বা উচ্ছিষ্ট নালা দিয়ে যেতে আটকা পড়ে। প্রতি সপ্তাহে একমুঠি বেকিং সোডা ড্রেনে দিয়ে গরম পানি ছেড়ে দিন ধোয়ার জন্য। ড্রেনের মুখে রাতে একটি নেপথলিন বল রাখুন আরশোলার উপদ্রব এড়ানোর জন্য।
ডিম
যদিও তাজা ডিম তেমন অপরিচ্ছন্ন নয়, তবুও ডিমের খোলা মুরগির মলে অপরিচ্ছন্ন হতে পারে। এই মল দীর্ণ খোলা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। ডিম সব সময় ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। ফ্রিজের শেলফে, দরজায় নয়। দ্রুত খেয়ে ফেলুন, বেশি দিন সংরক্ষণ করবেন না। কাঁচা ডিম খাবেন না। বৃদ্ধ ও রোগী, শিশু ও গর্ভবতী নারী সিদ্ধ ডিম খাবেন। খেতে হলে দেখে নেবেন ডিমের কুসুম ও সাদা অংশ দু’টিই সিদ্ধ হয়েছে কি না। কাঁচা ডিম নাড়াচাড়ার পর সব সময় হাত ধুয়ে নেবেন।
ফ্রিজ ও ফ্রিজার
ফ্রিজ ও ফ্রিজারকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে সঠিক তাপমানে নিয়মিত ডিফ্রস্ট করতে হবে। ঢাকা দেয়া বাটি বা ঠিকভাবে মোড়ানো আঁধারে আলাদাভাবে খাদ্য রাখতে হবে। কাঁচা বা রান্না নয়, এমন খাদ্যকে রান্না খাদ্যের নিচে রাখতে হবে, যাতে এটি অন্য খাবারে চুঁইয়ে না পড়তে পারে। ফ্রিজ বেশি ভর্তি করবেন না, এতে ঠাণ্ডা বাতাসের পরিচালনা সাবলীলভাবে হয় না।
ভাণ্ডারজাত করবেন কী করে?
খাদ্যকে সঠিকভাবে ভাণ্ডারজাত করা উচিত। ফুড লেবেলে সঞ্চয় কিভাবে করবেন, এর নির্দেশনাও থাকে। ভাণ্ডারের শেলফ, তাক যেন খুব পরিচ্ছন্ন থাকে, শুষ্ক ও ঠাণ্ডা থাকে। তেল, ময়দা, চিনি ও মসলা যেন থাকে শক্ত ঢাকনা দিয়ে বদ্ধ বায়ুমুক্ত পাত্রে। তাপও আলো থেকে দূরে।
চিকিৎসা যদি লাগে
সংক্রমিত খাবার খেলে বমি ভাব, বমি ও উদরাময় হতে পারে। হতে পারে ফুড পয়জনিং। টিকে থাকতে পারে তা ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়। সে সময় শরীরে পানিশূন্যতা না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই খেতে পারেন মুখে খাবার স্যালাইন। প্রচুর পানি পান করবেন। ডাবের পানি পান করবেন। ১ লিটার পানি চার চিমটি চিনি ও তিন চিমটি লবণ পান করতে পারেন। ভাতের মাড় খেতে পারেন নুন ও তেল দিয়ে। বার্লির পানি ১৫ মিনিট পরপর পান করুন। তাজা লেবুর রস, চিনি ও নুন যোগ করুন। পরদিন খান জাউ ভাত, সুপ ও শিং মাছের ঝোল।
তিন বছরের নিচে শিশুর ফুড পয়জনিং হলে ডাক্তার ডাকা উচিত, পূর্ণবয়স্ক লোকের এ অসুখ যদি দুই দিনের বেশি স্থায়ী হয়, তরল মল যদি প্রতি ১০-১৫ মিনিট পরপর হয়, এতে যদি রক্ত বা শ্লেষ্মা থাকে, পেটে যদি ব্যথা থাকে, জ্বর থাকে তাহলে ডাক্তার দেখানো জরুরি।
বাসন-কোসন ও তৈজসপত্র
ব্যবহারের পর যত তাড়াতাড়ি হয় বাসনপত্র ধুয়ে ফেলা উচিত। গরম পানি, ওয়াশিং আপ লিকুইড ব্যবহার করতে হবে। পরিষ্কার গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ঝেড়ে ফেলা উচিত। ডিশওয়াশার যাদের আছে এরা ঠিক পরিমাণ লবণ ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা উচিত এবং ফিল্টার ও সব কিছু পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
কড়াই, পাত্র এসব নিজে নিজে ধোয়া হয়ে যেতে পারে। গরম সাবান গোলা পানিতে ভরে এতে ভিজিয়ে রাখুন এসব। এরপর কেবল একটু ধোয়া লাগবে মাত্র। পোড়া বাসনে বেশি করে বেকিং সোডা ঢালুন। এরপর পানি ঢেলে কয়েক ঘণ্টা রাখুন।
সবজি
রান্নার আগে সবজি ও ফল ভালো করে ধুয়ে নিন। কাঁচা খেতে হলে এক ফোঁটা পটাশ মিশ্রিত পানিতে ধুয়ে নিন। বুফে টেবিল কাঁচা সালাদ পরিবেশন না করা ভালো। পেঁয়াজ ও আলু খোলা রাখুন কোনো শীতল অন্ধকার স্থানে। কাটার সময় পরিষ্কার চপিং বোর্ড ও ছুরি ব্যবহার করুন।
পানি
সংক্রমিত পানি পান করলে হরেক রকম অসুখ হতে পারে। যেমন ভাইবাল হেপাটাইটিস ‘এ’ ও পোলিও। জীবাণুজনিত কলেরা, টাইফয়েড, বাসিলারি আমাশয়, উদরাময়। পরজীবীজনিত এমিবীয় আমাশয়, জিয়ারডিয়াসিস, গোল কৃমি, চাবুক কৃমি, ফিতা কৃমি, সুতা কৃমি ও গিনি ওয়ার্ম।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিরেক্টর, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা।

 


আরো সংবাদ



premium cement