২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এডিনয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধিজনিত সমস্যা

-

একমাস পরই শীর্ষের বয়স হবে পাঁচ। সামনে স্কুলের পরীক্ষা। কিন্তু প্রায় সময়েই সে অসুস্থ থাকে। তার অসুস্থতার ধরনটা একটু ভিন্ন। অসুখের তীব্রতা দিনের বেলায় খুব একটা বোঝা যায় না। সকাল বেলা ঘুম ভাঙে নাক দিয়ে শ্লেষ্মা ঝরার অস্বস্তিকর ঘটনা দিয়ে। এর দিনের প্রায় পুরো সময়টাই নাক টানতে থাকে শীর্ষ। বারবার নাক ঝেড়ে পরিষ্কার করিয়ে দিতে হয়। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই ডাক্তারের পরামর্শে দেয়া হয় সর্দি কমানোর ওষুধ। ডা: সজল আশফাক

মাসের পর মাস ওষুধ চলছে। কিন্তু অবস্থার খুব একটা উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। শুধু নাক বন্ধই নয়, মাঝে মধ্যে দেখা দেয় কাশি ও হালকা জ্বর। তখন এন্টিবায়োটিক, এন্টি হিস্টামিন, নাকের ড্রপ ইত্যাদি দেয়ার দুই-চারদিন পর কিছুটা সুস্থ হয়। তবে এ অবস্থা স্থায়ী হয় না। এভাবেই চলছে গত দুই বছর ধরে। কিন্তু সমস্যা কমছে না বরং একটু একটু করে বাড়ছে। মাসখানেক হলো রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়। গভীর ঘুম হয় না। আধো ঘুম অবস্থায় সারারাত এপাশ ওপাশ করে, নাক ঘষেঁ, নাক দিয়ে শ্লেষ্মা ঝরে। শুয়ে ঘুমোতে না পেরে চোখবুজে বসে থাকে। এ অবস্থাতে আর কালক্ষেপণ না করে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেন শীর্ষের বাবা-মা। ডাক্তার শীর্ষকে পরীক্ষা করে দেখলেন, সাথে ন্যাসোফ্যারিংস অর্থাৎ নাসা গলবিল অঞ্চলের একটি এক্স-রে করাতে দিলেন। এক্স-রে দেখে ডাক্তার বললেন শীর্ষের এডিনয়েডের সমস্যা হয়েছে। অপারেশন করাতে হবে। অবশেষে অপারেশন হলোÑ এখন বেশ ভালো আছে শীর্ষ। ক্রমে এটা সুস্থ শিশুতে পরিণত হচ্ছে সে। শীর্ষের মতো এরকম এডিনয়েড সমস্যায় অনেক শিশুই ভুগছে। এডিনয়েড শব্দটি অপরিচিত হলেও সমস্যাটি কিন্তু হরহামেশাই দেখা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমেরিকায় যেসব কারণে শিশুদের অপারেশন করা হয় তার অন্যতম হচ্ছে এডিনয়েড অপারেশন।
টনসিল শব্দটি অনেকের কাছেই পরিচিত তাই গলার কোনো সমস্যা হলেই টনসিলের প্রসঙ্গ আসে। তাই অনেকেই এডিনয়েডের সমস্যাকে টনসিলের সাথে মিলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এডিনয়েড একটি পৃথক বস্তু। তবে টনসিলের সাথে এর কিছুটা গঠনগত মিল আছে। দুটোই মিলিত লিম্ফোয়েড টিস্যু বা লসিকা জাতীয় কোষ, অবস্থান করে নাসা গলবিল ও গলবিল অঞ্চলের ঝিল্লির ঠিক নিচে। ঊর্ধ্বশ্বাসনালী এবং খাদ্যনালীর সংযোগস্থলে টনসিল ও এডিনয়েড ছাড়া একইরকম আরো কতগুলো লসিকাগ্রন্থি থাকে যেমনÑ টিউবাল। টনসিল (এটি অবস্থান করে নাসাগলবিল অঞ্চলে যেখানে কানের সাথে নাসাগলবিলের সংযোগ স্থাপনকারী পথটি উন্মুক্ত হয়), জিহ্বার দু’পাশে অবস্থিত লিঙ্গুয়াল টনসিল ইত্যাদি। এ অঞ্চলের এসব লসিকাকোষ গোলাকার রিংয়ের মতো অবস্থান করে, একে বলা হয় ওয়েল্ডার্স রিং। ওয়েল্ডার্স রিংয়ের অন্তর্ভুক্ত এই এডিনয়েড জন্ম থেকেই থাকে। তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে এটি আকারে সবচেয়ে বেশি বড় হয় এবং আট থেকে ১০ বছর বয়সের মধ্যে এটি ছোট হতে থাকে। কারো বেলায় এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেই ঘটে বিপত্তি। তখন বিষয়টিকে এডিনয়েড গ্রন্থি বড় হওয়াজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
এডিনয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে : মনে করা হয়ে থাকে, বারবার ঊর্ধ্বশ্বাসনালীর ইনফেকশন এডিনয়েডের ওপর প্রভাব ফেলে। যার ফলে এডিনয়েড আকারে বড় হয়ে যায়। এ ছাড়া এলার্জিজনিত কারণেও এডিনয়েড বড় হয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এডিনয়েড বড় হয়ে গেলে বেশ কিছু উপসর্গ পরিলক্ষিত হয় :
* এডিনয়েড গ্রন্থি বেড়ে যাওয়ার কারণে নাকের বাতাস চলাচলের পথ সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফলে শিশু মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। নাকের পথ যথাযথভাবে খোলা না থাকায় নাকের মধ্যে শ্লেষ্মা জমে থাকে এবং নাক দিয়ে শ্লেষ্মা ঝরতে থাকে। একপর্যায়ে নাকের দুইপাশের সাইনাসে ইনফেকশন হয়। শিশু নাকাস্বরে কথা বলে। এমনকি রাতে ঘুমানোর সময় নাক ডাকতে পারে কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসে শব্দ হতে পারে।
* কানের সাথে ঊর্ধ্বশ্বাসনালীর সংযোগরক্ষাকারী পথটিকে বলা হয় ইউস্টেশিয়ান টিউব। এর পাশে থাকে এডিনয়েড। তাই এডিনয়েড বড় হলে ইউস্টিশিয়ান টিউবের পথটি রুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। ফলে মধ্যকর্ণে শ্লেষ্মা আবদ্ধ অবস্থায় জমে যেতে পারে, কানে ব্যথা হতে পারে এবং অবস্থাভেদে শিশু কানে কম শুনতে পারে।
* এডিনয়েড় বড় হয়ে যাওয়ার কারণে শিশুর নাক বন্ধ থাকে। ফলে শিশু মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। এই দিয়ে শ্বাস নেয়ার কারণে শিশুর খাবার গ্রহণে বিলম্ব কিংবা অসুবিধা হয়। এ ছাড়া শিশুর মুখের কোণ দিয়ে লালা পড়তে থাকতে পারে। দীর্ঘ দিন এ অবস্থা চলতে থাকলে শিশুর ঙপরের পাটির সামনের দাঁত উঁচু হয়ে যায়, মাড়ি নরম হয়ে পড়ে, নাক চেপে যায়, সর্বোপরি চেহারায় একটা হাবাগোবাভাব চলে আসে। সামগ্রিকভাবে এই উপসর্গগুলোর কারণে শিশুর চেহারায় যে পরিবর্তন সূচিত হয় তাকে বলা হয় ‘এডিনয়েড ফেসিস’। ‘এডিনয়েড ফেসিস’ এর চেহারার শিশুকে দেখতে অনেকটা হাবাগোবা বোকা বলে মনে হয়।
এডিনয়েড নির্ণয় কোনো কঠিন বিষয় নয় : একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ একটি শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে, অসুস্থতার ইতিহাস নিয়ে এবং একটি এক্স-রে করার মাধ্যমেই এডিনয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধির বিষয়টি বুঝতে পারেন।
এডিনয়েড সমস্যার চিকিৎসা মূলত অপারেশন : যদি এডিনয়েড গ্রন্থি বৃদ্ধির বিষয়টিই শিশুর মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়া, নাক বন্ধ থাকা ইত্যাদির কারণ বলে গণ্য হয়, তখন অপারেশনই হচ্ছে এর একমাত্র চিকিৎসা। শিশুর অপারেশনের প্রসঙ্গ এলে বেশির ভাগ বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু কথা হচ্ছেÑ এই সমস্যাটি শিশু বয়সেই হয় আর চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন। সুতরাং সময়মতো অপারেশন করিয়ে সমস্যার কারণে সৃষ্ট ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়ানো সম্ভব। সব অপারেশনের মতোই এডিনয়েড অপারেশনে সাধারণ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। তবে অজ্ঞান করে অপারেশন করতে হয় বলে শিশুকে অজ্ঞান করার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। এডিনয়েড অপারেশনের নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ১. যদি নাক প্রায়ই বন্ধ থাকে এবং এক্স-রে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। ২. এডিনয়েড বড় হয়ে যাওয়ার কারণে যদি মধ্যকর্ণে ইনফেকশন হয় এবং মধ্যকর্ণে তরল পদার্থ জমে আটকে থাকে। ৩. যদি বারবার মধ্যকর্ণের ইনফেকশন হয়। ৪. ঘুমের মধ্যে যদি শিশুর দমবন্ধ (স্লিপ এপনিয়া) অবস্থা হয়।
অপারেশন না করালে শিশুর বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে :
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে শিশুর নাক বন্ধ থাকার কারণে শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। ফলে শিশুর মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ বিঘিœত হয়। ফলে শিশুর বুদ্ধাঙ্ক কম হয়। এ ছাড়া শিশু ক্রমাগতভাবে কম শোনার কারণে ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে পড়ে, পড়াশোনায় খারাপ করে এবং শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়। একপর্যায়ে শিশুর মধ্যকর্ণের ইনফেকশন জটিল হয়ে কানের পর্দা ফুটো করে দেয় এবং শিশু কানপাকা রোগের নিয়মিত রোগী হয়ে যায়, অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী কানপাকা বা ‘সিএসওএম’ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তবে কথা হচ্ছে : নাকবন্ধ হওয়া, কানপাকা, কানে পানি জমা, মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। সেই সব কারণে সমস্যা হয়ে, থাকলে সেগুলোর চিকিৎসা নিতে হবে।
অপারেশনের পর শিশু ক্রমেই সুস্থ হয়ে ওঠে : শিশুর নাক বন্ধ অবস্থার উন্নতি হয়। এ সময়ে শিশু ঘুমের মধ্যে মুখ খুলে শ্বাস নিতে থাকলে মুখ আস্তে করে বন্ধ করে দিয়ে, নাক দিয়ে শ্বাস নিতে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এলার্জি থাকলে অপারেশনের পর শিশুকে এলার্জির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ দিতে হবে। অপারেশনের দুই-তিন দিনের মধ্যেই শিশু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে শিশু সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কাজেই শিশুর এডিনয়েড সমস্যাকে খাটো করে না দেখে সময়মতো চিকিৎসা করিয়ে শিশুকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

চেম্বার : ইনসাফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইস্কাটন, ঢাকা। মোবাইল : ০১৫৫২৩০৮৬২৩


আরো সংবাদ



premium cement
ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মিজানুরের ইন্তেকাল থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সাথেপ্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ গ্যাস বিতরণে সিস্টেম লস ২২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে : নসরুল হামিদ গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

সকল