২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্রনিক হেপাটাইটিস বি এক মারাত্মক অসুখ

-

ক্রনিক হেপাটাইটিস বি লিভারের একটি মারাত্মক অসুখ। বাংলাদেশে আনুমানিক এক কোটির বেশি লোক দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি রোগের বাহক। বাহকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের লিভার ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি সম্পর্কে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক ডা: মাহবুব এইচ খান

১৯৬৩ সালে রমবার্গ নামের এক আমেরিকান চিকিৎসাবিজ্ঞানী একজন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীর মধ্যে লিভার প্রদাহ (হেপাটাইটিস) সৃষ্টিকারী একটি জীবাণুর সন্ধান পান। অসুখ সৃষ্টিকারী এই জীবাণুটি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নামে পরিচিত। হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ছয় মাস পরও যদি ভাইরাসটি শরীরে অবস্থান করে তাহলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) বাহক বলা হয়। এসব রোগীর একটি বড় অংশ ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এটা একটা মারাত্মক অসুখ। সারা বিশ্বে ৩৫ কোটিরও বেশি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বহন করছে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসযুক্ত রক্ত অথবা রক্তের অন্যান্য উপাদান রোগীর শরীরে দেয়া, শিরাপথে নেশগ্রস্ত ওষুধ ব্যবহার করা ও যৌনমিলনের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। গর্ভবতী মা থেকে যদি নবজাতক হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তার নবজাতকের ক্রনিক হেপাটাইটিস বি হওয়ার ঝুঁকি ৯০ ভাগ। ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত না করে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, দাঁতের চিকিৎসা এবং অপারেশনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য হেপাটাইটিস বি রোগ ছড়ানোর সমূহ সম্ভাবনা থাকে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগীর অনেকের মধ্যে কোনো রকম লক্ষণ ও উপসর্গ না-ও থাকতে পারে। কোনো কারণে রক্ত পরীক্ষার সময় এসব রোগীর অনেকের মধ্যে বি ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে। তাই রোগের লক্ষণহীন রোগীরা নিজের স্বাস্থ্য এবং সমাজের অন্যের স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকির কারণ। শারীরিক দুর্বলতা, অল্প কাজ করার পর মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়া, উপরের পেটের ডান পাশে ব্যথা অথবা অস্বস্তি বোধ করা, মাঝে মাঝে জন্ডিস এবং ক্ষুধামন্দায় আক্রান্ত হওয়া, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, দাঁত ও নাক থেকে রক্তপাত হওয়া, লিভার ও পীড়া বেড়ে যাওয়ার উপসর্গ ও লক্ষণগুলো নিয়েও অনেকেই চিকিৎসকের কাছে আসেন। তবে অনেকেই লিভার সিরোসিস অথবা তার ক্ষতিকারক উপসর্গ ও লক্ষণ নিয়েও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি লিভারের একটি মারাত্মক অসুখ। বাংলাদেশে আনুমানিক এক কোটি লোক দীর্ঘমেয়াদিভাবে রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বহন করে বেড়াচ্ছে এবং তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্তদের শতকরা ২০-৩০ ভাগ ২০-৩০ বছরের মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় লিভারের কার্যক্ষমতা আস্তে আস্তে স্বাভাবিকের চেয়ে কমতে থাকে। এর ফলে একপর্যায়ে লিভার ফেইলিউর, রক্তবমি, লিভার ক্যান্সার, পেটে পানি জমা এবং জন্ডিস সমস্যার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটে। এখানে উল্লেখ্য, মদপান এবং লিভারে হেপাটাইটিস ডি ও সি ভাইরাসের উপস্থিতি হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্তদের জটিলতাকে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে। যেহেতু এসব রোগীর মধ্যে অনেকের কোনোরকম রোগ লক্ষণও দেখা দেয় না, সেজন্য ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-এর রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ না থাকলেও রক্ত পরীক্ষা করে নেয়া যেতে পারে। পরীক্ষার পর রোগীর রক্ত ঐইংঅম চড়ংরঃরাব হলে অবশ্যই লিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। যাদের রক্তে এই ভাইরাসের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যাবে না অর্থাৎ ঐইংঅএ ঘবমধঃরাব হবে তাদের এই ভাইরাসের টিকা নেয়া উচিত। যাদের টিকা কার্যকর হয় ভবিষ্যতে তাদের হেপাটাইটিস বি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যাবে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগের চিকিৎসা
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসা মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে রোগের ক্রমবিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকারক দিকগুলোকে বন্ধ অথবা মন্থর করে দেয়া। অর্থাৎ বি ভাইরাসকে অকার্যকর অবস্থায় ফিরিয়ে এনে লিভারের ক্ষতকে সম্পূর্ণ ভালো করা বা কমিয়ে আনা। এ ছাড়া লিভারে ফাইব্রাস টিস্যু জমাকে প্রতিহত করে লিভারের ক্ষতিকারক রোগগুলোকে ঠেকানো। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে বেশ কয়েকটা ওষুধ হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে : পেগইন্টারফেরন, ল্যামিভুডিন, এডিফোভির, ডিপেক্ষাক্লিল, অ্যান্টিকাভির, টেনোফডিব টেলভিভুডিন ইত্যাদি। তবে পেগইন্টারফেরন এবং ল্যামিভুডিন ও এডিফোভির এই তিনটি ওষুধই দুনিয়াজুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইদানীং অ্যান্টিকাভির ও টেনোফোভির উন্নত দেশগুলোতে ব্যবহার হওয়া শুরু হয়েছে। পেসইন্টারফেরন ইনজেকশন হিসেবে রোগীকে দেয়া হয়। রোগীর রোগ পূর্ণ বিশেষণের পর ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত ঠিকমতো ওষুধ প্রয়োগে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রোগী রোগমুক্ত হতে পারেন। ইন্টারফেরন ইনজেকশনের ফলে বেশ কিছু রোগী সাধারণ থেকে ব্যাপকভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে পারেন। অল্প সংখ্যক রোগী এটা সহ্য না-ও করতে পারেন। ইন্টারফেরন ইনজেকশনটি রোগীর কখন এবং কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে তার বিশদ বিশ্লেষণ করে রোগীকে না দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে, বিশেষ করে যাদের লিভারের কার্যক্ষমতা অনেক কমে এসেছে। ১০-১২ বছর ধরে ল্যামিভুডিন নামের বডিটি বিশ্ব বাজারে হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটা খাওয়ার একটি ওষুধ এবং ইন্টারফেরনের চেয়ে দাম অনেক কম। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ইন্টারফেরনের চেয়ে অনেক কম, তবে সম্পূর্ণ সমস্যামুক্ত নয়। ঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এক বছরের চিকিৎসায় শতকরা ১৫-২১ ভাগ রোগীর ভাইরাস অকার্যকর হয়। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় ভাইরাস অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণীর রোগীদের জন্য এবং দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ফলে (২-৩ বছরে) ২৭-৬৫ শতাংশ রোগীর রোগমুক্তির সম্ভাবনা আছে। সবচেয়ে সুবিধাজনক বিষয় হলো যে ক্ষেত্রে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসায় ইন্টারফেরন ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ সেসব ক্ষেত্রে ল্যামিভুডিন ব্যবহার করা যেতে পারে। ১-৩ বছর ওষুধ ব্যবহারের ফলে ১৫-৫০ শতাংশ রোগীর রক্তে ভাইরাসের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়, ফলে ওষুধের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। তা ছাড়া ওষুধ বন্ধের পর ও চলাকালীন কিছু রোগীর লিভার ফেইলিউরের ঝুঁকি দেখা দেয়।
এসব কারণে বর্তমানে এডিফোভির, অ্যান্টিকাভির ও টেলাবিভুডিন ল্যামিভুডিনের স্থান দখল করে নিচ্ছে। উপরি উক্ত প্রথম তিনটি ওষুধ ১-৩ বছর প্রয়োগ করলে যথাক্রমে ১০-৪০ শতাংশ, ২০-৪০ শতাংশ এবং ২০-৩৫ শতাংশ রোগীর ভাইরাস অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়াও এসব ওষুধ ব্যবহারে ভাইরাসের কাঠামোগত পরিবর্তন এনে ওষুধের কার্যক্ষমতা নষ্ট করার সম্ভাবনা ল্যামিভুডিনের তুলনায় অনেক অনেক কম বরং এই ওষুধগুলো ল্যামিভুডিন চিকিৎসার ফলে যেসব রোগীর ভাইরাস অকার্যকর করার ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে তাদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

লেখক : লিভার বিশেষজ্ঞ, সিটি হাসপাতাল, লালমাটিয়া, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১৮৫৪৩৩৮


আরো সংবাদ



premium cement