১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাদ্যেই স্বাস্থ্য, খাদ্যেই মৃত্যু

খাদ্যেই স্বাস্থ্য, খাদ্যেই মৃত্যু - সংগৃহীত

যেকোনো দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাদের খাদ্যাভ্যাস। জাতিগত পৃথকীকরণের একটি অন্যতম মানদণ্ড এই বিষয়টি। পুষ্টিকর খাদ্য যেমন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য একইভাবেই বিপরীত ভূমিকা পালন করে আমাদের দেহে। অপুষ্টিজনিত বা বিভিন্ন মারাত্মক রোগের পেছনে রয়েছে মানুষের খাদ্যাভ্যাস।

সম্প্রতি চলমান সবথেকে আলোচিত করোনা ভাইরাসটির দিকে আলোকপাত করলেই আমরা এর উদাহরণ দেখতে পাই। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী করোনা মহামারীর শুরু থেকেই সন্দেহ করা হচ্ছিল, চীনের উহান প্রদেশের প্রচলিত বন্য প্রাণী ভক্ষণের অভ্যাসের কারণেই বিস্তার লাভ করছে ভাইরাসজনিত এ রোগটি। অবশেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নিশ্চিত করেছে,বাদুর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে মারণঘাতী এই ভাইরাস এবং পরে চীনে নিষিদ্ধ হয়েছে বাদুর বা অন্যান্য বন্য প্রাণী খাওয়া।
শুধুমাত্র চীন নয়,বাঙালি জাতির খাদ্যাভ্যাসও বিভিন্নভাবে আবহমান কাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য ও গতিবিধিকে।

২০০৯ সালে মেক্সিকোতে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ লাভ করে“এইচ-১এন-১” ভাইরাসে সংক্রমিত সোয়াইন ফ্লু/বার্ড ফ্লু রোগটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল বিশ্বব্যাপী। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এই রোগে পৃথিবীজুড়ে প্রাণ হারায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে ১০২ জন রোগী শনাক্ত হলেও মৃতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি সেই রোগে। এই রোগের প্রারম্ভ থেকেই ধারণা করা হচ্ছিলো শূকর,মুরগি ও অন্যান্য পাখি থেকে বিস্তার লাভ করছে বার্ড ফ্লু নামক ব্যাধিটি। বাংলাদেশে এই রোগের সংক্রমণের হার কম হওয়ার পেছনেও কারণ দর্শানো হয় মানুষের খাদ্যাভ্যাসকে। শূকর ইউরোপ,আমেরিকার জনপ্রিয় খাদ্য হলেও বাংলাদেশে তেমন একটা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি কখনোই। তার উপরে রসনাবিলাসী বাঙালিরা যেকোনো গোশত জাতীয় খাবার কসিয়ে খেতেই বেশি পছন্দ করে। ওই সময়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল গোশত আছে- এমন যেকোনো খাবার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালোভাবে সিদ্ধ করে খাওয়ার জন্য।

প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি জাতির প্রধান খাবার ভাত। প্রচুর পরিমাণে শর্করার যোগান থাকলেও স্থূলতা,গ্যাস্ট্রিক আলসার বা ডায়বেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় অতিরিক্ত ভাত খাওয়া। আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টের কুইন্স ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক দাবি করেন ভুল পদ্ধতিতে রান্না করা ভাতের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে ডায়বেটিস ও ক্যান্সারের মতো রোগের। টেলিগ্রাফের একটি প্রতিবেদনে ভাত রান্নার আগে সারারাত চাল ভিজিয়ে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এতে ধান চাষের সময় জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক কীটনাশকের মাত্রা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বর্তমানে অল্প সময়ে রান্নার কাজে ব্যাবহৃত হয় রাইস কুকার। সাধারণত এই বৈদ্যুতিক যন্ত্রে রান্নায় প্রয়োজন পড়ে না কোনো মাড় ফেলে দেয়ার। ভাত রান্নার এই পদ্ধতি হতে পারে স্থূলতার কারণ। মূলত চাল সিদ্ধ করার সময় দানা ফেটে ক্ষতিকর স্টার্চ মিশে যায় পানিতে। স্থূলতা থেকে মুক্তি পেতে এই স্টার্চমিশ্রিত পানি ফেলে দিয়ে ভাত খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

চলমান পরিস্থিতিতে যেহেতু এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কার করে সুসংবাদ দিতে পারেননি গবেষকরা। এ কারণে সুষম খাদ্য অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে ইম্যুনিটি সিস্টেম শক্তিশালী করার কথা ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। শরীরকে রোগ থেকে রক্ষাকারী এন্টিবডি সাধারণত প্রোটিন দ্বারা গঠিত। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য আমিষসমৃদ্ধ মাছ, গোশত, ডিম, দুধ ও ডাল খাওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন এখন বিশেষজ্ঞমহল।

শরীরের ফ্রি র‌্যাডিক্যাল স্ক্যাভেঞ্জার বলা হয় এন্টি-অক্সিডেন্ট বা ভাইটামিন সিকে। ভাইটামিন সিও এক ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট। ফ্রি র‌্যাডিকেল মূলত দায়ী আমাদের বার্ধক্যের জন্য। বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার দ্রুতকরণ করে এই ফ্রি র‌্যাডিক্যাল। স্ক্যাভেঞ্জার বলতে 'ঝাটার মতো' বস্তু বোঝায়। ঝাটা যেভাবে নোংরা দূর করে,এন্টি অক্সিডেন্ট আমাদের শরীর থেকে ফ্রি র‌্যাডিকেলগুলোকে সেভাবেই ঝেটিয়ে বিদায় করে। এতে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া মন্থর হয় এবং বার্ধক্যজনিত রোগ থেকে মুক্তি পায় আমাদের শরীর। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত মৌসুমী ফলে যেমন আম,লিচু,আনারস,তরমুজ প্রভৃতিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। এন্টিঅক্সিডেন্ট।এছাড়াও লেবু বা টকজাতীয় ফলকে ভাইটামিন সি-এর আধার বলা হয়।

রমজান মাসে ইফতারিতে বেগুনি, পেঁয়াজুর মতো মুখোরোচক খাবার কে না খেতে চায়। অথচ যেই ফ্রি র‌্যাডিকেল স্ক্যাভেজ করার কথা বলা হচ্ছে,এসকল ভাজাপোড়াই সেই র‌্যাডিক্যালের মূল উৎস। আবার বাসাবাড়িতে বা রেষ্টুরেন্টে অনেকেরই স্বভাব রয়েছে পোড়া তেল বা একই তেল দিয়ে বারবার রান্না করার।এই তেলটির মাধ্যমেও শরীরে প্রবেশ করতে পারে ফ্রি র‌্যাডিক্যাল।

দুধের গ্লাস হাতে মায়েদের সন্তানের পিছে ছুটে বেড়ানো আমাদের অতিপরিচিত দৃশ্যগুলোর একটি। আবার সেই শিশুই প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধ চকলেট বা মিষ্টান্ন খাবারের ভক্ত দেখা যায়। দুধে সকল ভাইটামিন এবং মিনারেলস রয়েছে বলেই দুধ সুষম খাদ্য। কিন্তু দুগ্ধজাত বিভিন্ন চকলেট,মিষ্টান্ন বা অন্যান্য খাবারের কারণে শরীরে জমা হতে পারে বিষাক্ত উপাদান। এতে শরীর হয়ে যেতে পারে দুর্বল এবং খুব সহজেই বাসা বাঁধতে পারে ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাস। তবে রোজ এক গ্লাস ফোটানো দুধ পানে পূর্ণ হয় শরীরের পুষ্টি চাহিদা এবং মজবুত হয় শরীরের হাড়গুলো। আমাদের দেশে প্রায়ই বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায় হাড় বেড়ে যাওয়া বা হাড় ক্ষয় হওয়ার সমস্যাগুলো। বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য জটিলতার কারণে অনেক সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় দুধের উপর এবং পরামর্শ দেয়া হয় বিভিন্ন ভাইটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ বাজারজাত সাপ্লিমেন্টস। অল্প বয়সে দুধ খাওয়ার অভ্যাসে মুক্তি মিলতে পারে এসকল সমস্যা হতে।

বিশ্বব্যাপী মস্তিষ্কে উদ্দীপনা প্রদানকারী হিসেবে জনপ্রিয় একটি পানীয় চা। উত্তর-পূর্ব ইরানের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপর গবেষণা চালিয়ে আমেরিকান ক্যান্সার গবেষণা সোসাইটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০° সেলসিয়াসের অতিরিক্ত গরম চা খাদ্যনালিতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। অতিরিক্ত গরম চা যদি কোনো ব্যক্তি রোজ ৭০০ এমএল পান করেন তবে তার গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বাড়ে।
এছাড়াও অনেক্ষণ ধরে চা ফোটানোর কারণে চা-পাতার মধ্যে থাকা ট্যানিন সদৃশ কারসিনোজেনিক উপাদানগুলো সক্রিয় হয়। এতে ঝুঁকি বেড়ে যায় ক্যান্সার বা টিউমারের।
মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম উপাদান খাদ্য। সুস্থ ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস শরীরের ঢালস্বরূপ কাজ করে। পক্ষান্তরে, অজ্ঞতা বা অভ্যাসের বশবর্তী ক্ষতিকর খাদ্যগুলো মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুমুখে।

লেখক : শিক্ষার্থী, এমএসইন ফার্মাকোলজি
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর


আরো সংবাদ



premium cement