১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
করোনা নিয়ে বিশেষজ্ঞ বক্তব্য

 বাংলাদেশের বিশেষ ঝুঁকি ও প্রতিরক্ষা

অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম - সংগৃহীত

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী মুসলিমপ্রধান হওয়ায় ধর্মীয় আবশ্যকতায় তারা মসজিদে গিয়ে দৈনিক ৫ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ আদায় করেন। মুসল্লিদের অনেকেই বয়স্ক ও সাধারণভাবে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। ইবাদত-বন্দেগির জন্য কেউ কেউ সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। ফলে, বয়স্ক ও সাধারণভাবে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত ও আলাদা করা কঠিন। ফলে সংক্রমিত ওই অজানা ব্যক্তির অসুস্থতাজনিত হাঁচি-কাশিতে এবং সিজদার সময় জায়নামাজ ও মেঝে দূষিত হয়ে পড়তে পারে। তাই বয়স্ক ও সাধারণভাবে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মসজিদে যাওয়া নিজে থেকেই পরিহার এবং পরিবারিক ও সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদগুলোতে সংক্রমণ নিরোধে উপযুক্ত বিধিনিষেধের পাশাপাশি আপদনিরোধী অবশ্য করণীয় আরোপ ও তার প্রতিপালন নিশ্চিত করা না গেলে প্রবল ধর্মীয় আবেগের কারণে মসজিদগুলো ব্যাপক সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতে পারে।

প্রতিটি মসজিদেই ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকায় করোনাসংক্রান্ত মসজিদ ব্যবস্থাপনা সহজসাধ্য হওয়া উচিত। মসজিদে উপসর্গ আক্রান্ত মানুষের যাতায়াত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উদ্যোগে নিরুৎসাহিত ও মসজিদের প্রবেশ পথে স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মসজিদ থেকে কার্পেট অপসারণ, নামাজের আগে ও পর জীবাণুনাশক দিয়ে মেঝে মোছা বেশ কার্যকর হতে পারে। এ পদক্ষেপ দেশের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় আচরণ প্রতিপালনে স্বাস্থ্যসম্মত ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে। মসজিদগুলোকে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরির সামাজিক প্রাণকেন্দ্র করে তোলা যায়। প্রয়োজনে জনমত গড়ে তোলাসাপেক্ষে মসজিদগুলো বন্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে।

মসজিদের মতো দেশের অন্যান্য সাধারণ জনসমাগমের স্থান হলো স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্তোরাঁ, শপিং সেন্টার, গণপরিবহন, বন্দর, সামাজিক কেন্দ্র, সড়কপাশর্^স্থ সাধারণ জটলা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল-চিকিৎসাকেন্দ্র। এগুলোর প্রতিটি স্থানে অনাবশ্যক যাতায়াত বা অবস্থান এড়িয়ে চলা উচিত। এসবের মধ্যে হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে চিকিৎসা নিতে আসা অসুস্থ ব্যক্তির সাথে অধিক ও অপ্রয়োজনীয় সংখ্যক পারিবারিক সহযোগী চিকিৎসাকেন্দ্রে আসেন। বাড়িতে ও হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে ভর্তি রোগী দেখতে আসার প্রচলনও ব্যাপক। ফলে রোগী ও হাসপাতালকেন্দ্রিক রোগ সংক্রমণের ব্যাপক আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে সাধারণ সর্দি-জ্বর-কাশির জন্য চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য অন্য রোগীদের থেকে অপেক্ষাকালীন সঙ্গনিরোধী পৃথকীকরণ ও সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা না হলে এবং সামান্য সাধারণ সর্দি-জ্বর-কাশিতে আক্রান্তদের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা না থাকা ও তা পরিহার করার পাশাপাশি হটলাইন টেলিফান ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা না হলে সংক্রমণ দ্রুত ও ব্যাপকভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

উল্লেখ্য, মৃদু রোগাক্রান্ত যাদের অনুপাত ৬৩ শতাংশের বেশি তারা মৃত্যুঝুঁকিমুক্ত ও সাধারণভাবে মামুলি উপশমমূলক চিকিৎসায় সাত দিনের মধ্যে রোগমুক্ত হওয়ার আশা করতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে বা চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়ার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি ব্যক্তির নিজের ও অপরের স্বার্থেই যাওয়া পরিহার করা উচিত। কেননা সাধারণ সর্দি-জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এলে নিজেরা যেমন সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বেন তেমনি পরিবার ও পারিপার্শ্বিকে রোগ ছড়ানের উৎস হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে সেবা নেয়ার লক্ষণগুলোকে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতায় আনা দরকার।

বাংলাদেশে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি বৈকল্য এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় এমন রোগাক্রান্ত মানুষের সম্মিলিত সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে অ্যাজমা, ফুসফুসের যক্ষা, উচ্চ বায়ুদূষণ জনিত ফুসফুসের রোগের কথা উল্লেখ করা যায়। শিশুদের নিউমোনিয়ার প্রবণতা কম বয়স্কদেরও উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। জনবহুলতা, বসবাসের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গণপরিবহনে প্রচণ্ড ভিড়, বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসম্মত আচরণের অভাব, উচ্চমাত্রার পরিবেশ দূষণ, ব্যাপক অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্যহানি, সাধারণ স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এই জনপদকে সাধারণভাবে স্বাস্থ্য বিষয়ে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে।

যদিও ২০১৯-হঈড়ঠ-এর কোনো স্থানীয় আধার এ দেশে নেই ও স্বতঃস্ফূর্ত সংক্রমণের উদ্ভব ঘটা অবান্তর। বহির্বিশে^র সাথে এ দেশের ব্যাপক যোগাযোগের কারণে সংক্রমিত দেশ থেকে ভাইরাসটির আগমন ও সংক্রমণের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে। পার্শ্ববর্তী জনবহুল দেশ ভারতের সাথে আমাদের বিস্তৃত স্থলসীমান্ত এবং নানা পথে ব্যাপক জন ও যান চলাচল রয়েছে। সেখানেও এ রোগের বিস্তার ঘটছে। আমাদের দেশের এক কোটির বেশি প্রবাসী ইতালি, স্পেন, যুক্তবাজ্য, জার্মানিসহ ইউরোপের নানাসংলগ্ন দেশ, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশে কর্মসূত্রে বসবাস করেন তার সব ক’টিতেই এ রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। এসব দেশের সাথেও আকাশপথে মানুষের চলাচল উল্লেখযোগ্য। গণচীনের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগও ব্যাপকমাত্রায়। সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি খুবই বেশি। ফলে অর্ধ শতাব্দী আগে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা লাভকারী এ দেশের সব আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন কল্পে এ জনপদকে ভয়ঙ্কর এ বৈশি^ক স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা এ জনপদকে বিরান ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলার হুমকি সৃষ্টি করেছে, তাকে উপেক্ষা বা খাটো করে দেখার ধৃষ্টতা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।

লেখক : সাবেক ডিন, সার্জারি অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্বিবিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement