১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোগের নাম ডিপথেরিয়া

-

ডিপথেরিয়া হলো করাইনিব্যাকটিরিয়াম ডিপথেরি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মানব দেহে সঙ্ঘটিত এক ধরনের সংক্রামক রোগ। মানুষই এই রোগের একমাত্র পোষক। সাধারণত মানবদেহের ঊর্ধ্ব শ্বসনতন্ত্র কিংবা বিরল ক্ষেত্রে ত্বক ও চোখের কনজাংটিভা এই রোগে আক্রান্ত হয়। লিখেছেন ডা: মো: কফিল উদ্দিন চৌধুরী
সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কিংবা ত্বকের ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির আক্রান্ত ত্বকের সরাসরি সংস্পর্শে এই রোগ অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তিতে ছড়ায়। অসম্পূর্ণ টিকাদান কর্মসূচি, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশ, জনসংখ্যাধিক্য, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, শরণার্থী সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ এই রোগের বিস্তার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
সাধারণত ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এবং সেই সাথে ব্যাপক গণসচেতনতায় বিগত ৩৫ বছর ধরে এই রোগের রিপোর্ট আমাদের দেশে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৯৭৬ সালে গলায় ডিপথেরিয়া ও ১৯৮৩ সালে ত্বকের ডিপথেরিয়া রোগী শনাক্তকৃত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ৩ নভেম্বর ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা বালুখালী শরণার্থী শিবিরে ৩০ বছর বয়সী এক মহিলার দেহে এই রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। সর্বশেষ ১০ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ৪,০০০ রোহিঙ্গা এই রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৩১ জন। এ ছাড়া সবচেয়ে বিপজ্জনক কথা হলো এই রোগ বর্তমানে উক্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী থেকে স্থানীয় বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ রিপোর্টকৃত ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত বাংলাদেশীর সংখ্যা ১৯ জন। যদি এখনই এই রোগের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তবে তা মহামারী আকারে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রোগের লক্ষণ ও জটিলতা
এই রোগে সাধারণত মানব দেহে নিম্নলিখিত এক বা একাধিক উপসর্গ নিয়ে দেখা দিতে পারে-
জ্বর
গলাব্যথা
নাক দিয়ে পানি বা রক্ত মিশ্রিত পানি পড়া
অস্বস্তিভাব
কর্কশ গলা
কাশি
ঢোক গিলতে ব্যথা হওয়া বা কষ্ট হওয়া
গলা ফুলে যাওয়া
শ্বাস নেয়ার সময় শব্দ হওয়া
শ্বাসকষ্ট
ক্লান্তি বা অবসন্নতা বা দেহ নিস্তেজ হয়ে যাওয়া
রোগের তীব্র পর্যায়ে রোগী শকে চলে যাওয়া
রোগীর পালস তথা ধমনির গতি বেড়ে যাওয়া
আক্রান্ত রোগীর নাক, গলবিল, স্বরযন্ত্র, শ্বাসনালী, মুখের তালু, আলা-জিহ্বা প্রভৃতি এক বা একাধিক স্থানে সাদাটে-ধূসর, পুরু ও আক্রান্ত স্থানের সাথে দৃঢ়ভাবে সংলগ্ন আস্তরণ পড়া।
সঠিকভাবে যথাযথ সময়ে চিকিৎসা না নিলে আক্রান্ত ব্যক্তিতে নিম্নলিখিত এক বা একাধিক জটিলতা দেখা দিতে পারে :
মুখ গহ্বরের তালু, গলবিল, মুখ, স্বরযন্ত্র ও চোখের নড়নে সহায়ক পেশির নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহের কর্মক্ষমতা লুপ্ত হওয়া।
বিরল ক্ষেত্রে হাত ও পায়ের সঞ্চালনে সহায়ক পেশিসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহের বিকারগ্রস্ততা।
হার্ট তথা হৃদযন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টিপূর্বক এর কার্যে ব্যাপক ছন্দপতন, কিংবা হার্ট ফেইলিওর কিংবা তীব্র পর্যায়ে হার্টের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে গিয়ে আক্রান্ত রোগীর শকে চলে যাওয়া।
রেনাল ফেইলিওর তথা অস্থায়ীভাবে কিডনির কর্মক্ষমতা লুপ্ত হওয়া।
শ্বসনতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ তথা নিউমোনিয়া।
রোগ নির্ণয়
সাধারণত মহামারী পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে রোগের যথাযথ ইতিহাস ও নানা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে মানবদেহে এই রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তবে বিচ্ছিন্ন ও সন্দেহভাজন ক্ষেত্রে রোগীর আক্রান্ত স্থান হতে রস ও কোষ কলায় উক্ত জীবাণুর নানা জীবাণুতাত্ত্বিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়।
চিকিৎসা
সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তিতে এই রোগের চিকিৎসাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় :
(ক) এন্টিবায়োটিক থেরাপি
যথাযথ সময়ে সঠিক এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার এই রোগের বিস্তার ও আক্রান্ত ব্যক্তিতে এই রোগের তীব্রতা অনেকগুণ কমিয়ে আনতে পারে। এই রোগের চিকিৎসায় পেনিসিলিন, ইরাইফ্রোমাইসিন কিংবা অ্যাজিথ্রোমাইসিন নামক এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। সাধারণত রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীকে মুখে ওষুধ দেয়া হয়। তবে রোগের তীব্র পর্যায়ে গিলতে অসুবিধা হলে শিরাপথে এন্টিবায়োটিক দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
(খ) এন্টিটক্সিনের ব্যবহার
মূলত ডিপথেরিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর সব উপসর্গ ও জটিলতা উক্ত রোগের জীবাণু থেকে নিঃসৃত এক ধরনের টক্সিন বা বিষাণু দ্বারা সঙ্ঘটিত হয়। তাই রোগের চিকিৎসায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই টক্সিনের বিরুদ্ধে কার্যকর এন্টি-টক্সিন ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। কারণ উক্ত এন্টি-টক্সিন রোগীর রক্তে তথা কোষকলায় নিঃসৃত টক্সিনকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। যদিও কোষ-কলায় এরই মধ্যে সক্রিয় টক্সিনের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।
(গ) সহায়ক চিকিৎসা
ডিপথেরিয়া রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসার পাশাপাশি উপসর্গভিত্তিক বিভিন্ন সহায়ক চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। যেমন- জ্বর থাকাকালে জ্বরের চিকিৎসায় প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ দেয়া যেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা হয়। যদি রোগী মুখে খেতে না পারে তবে শিরাপথ কিংবা অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নেসোগ্যাস্ট্রিক ফিডিং তথা নল দিয়ে খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। রোগের জটিল পর্যায়ে বিশেষত হৃদযন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র, কিডনি কিংবা স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা লুপ্ত হলে প্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউতে রেখে নিবিড়ভাবে নানা জীবন রক্ষাকরী সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেয়া হয়।
রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে করণীয়
(ক) রোগী পর্যায়ে করণীয়Ñ
আক্রান্ত রোগীকে যথাসম্ভব পৃথক রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।
আক্রান্ত রোগীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত রুম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির পয়োনিষ্কাশনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পন্থা অনুসরণ করা যেতে পারে।
আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগীর সংস্পর্শে আসার সময় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাউন, মাস্ক, গ্লাভস, গুগলস প্রভৃতি ব্যবহার করতে হবে।
প্রতিবার আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার আগে ও পরে হাত যথাযথভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা যেমন- পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্য ব্যক্তিদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রোগবারক হিসেবে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
(খ) কমিউনিটি তথা গণপর্যায়ে করণীয়
আক্রান্ত ব্যক্তিকে এন্টিবায়োটিক শুরুর পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্কুল ও কাজে যাওয়া তথা অন্যান্য ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের জন্য রোগবারক হিসেবে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক দেয়া যেতে পারে।
সেই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে বিশেষত ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিশ্চিত করতে এই রোগের প্রতিরোধে টিকাদান।
সেই সাথে তৃণমূল পর্যায়ে এই রোগের মনিটরিং তথা নজরদারি করার ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য প্রশাসনকে।
এই রোগের প্রতিরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব কার্যক্রমের যথাযথ সমন্বয় সাধন।
সেই সাথে সরকারসহ গণমাধ্যম এই রোগের প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : মেডিসিন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
ফোন : ০১৫৫৭৪৪০২৮৭

 


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল